Image description
 

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সদ্যপ্রয়াত খালেদা জিয়ার জন্ম ব্রিটিশ ভারতের জলপাইগুড়িতে, যা তখন বৃহত্তর দিনাজপুরের অংশ ছিল এবং ভারতবর্ষ ভাগের পর ভারতের অংশে পড়েছিল।

তবে বাংলাদেশে যিনি দশ বছরেরও বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই বিএনপি নেত্রীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক পুরোপুরি সহজ বা স্বাভাবিক ছিল - এটা কখনোই বলা যাবে না।

 

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী (ফার্স্ট লেডি), প্রধানমন্ত্রী বা এমন কী বিরোধী নেত্রী হিসেবেও তিনি গত আটচল্লিশ বছরে অজস্রবার ভারত সফরে এসেছেন, ভারতের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে অসংখ্য বৈঠক করেছেন।

কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, দুপক্ষের সম্পর্কের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর বিষয় বরাবরই থেকে গেছে – সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

 

বলা যেতে পারে, ভারতের কংগ্রেসি বা অ-কংগ্রেসি সরকারগুলো এবং খালেদা জিয়া-র নেতৃত্বাধীন বিএনপি-র মধ্যে একটা পারস্পরিক সন্দেহ বা অবিশ্বাস প্রায় চিরকালই রয়ে গিয়েছিল।

পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের স্লোগান দিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিল যে বিএনপি – তাদের তথাকথিত 'ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি'ই এর একটা বড় কারণ।

 

বিএনপি নেতারা অবশ্য যুক্তি দেন, 'নতজানু পররাষ্ট্রনীতি'র শৃঙ্খল থেকে খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে বের করে আনতে চেয়েছিলেন বলেই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংঘাত তৈরি হয়েছিল – কিন্তু তিনি বাংলাদেশের স্বার্থকেই চিরকাল অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছেন।

আবার উল্টোদিকে ভারতের সাবেক কূটনীতিকদের অনেকেরই বিশ্বাস, খালেদা জিয়ার আমলে ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের জায়গাগুলোতে উদ্বেগের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল বলেই দু'পক্ষের সম্পর্কে একটা সময় চরম অবনতি হয়েছিল।

তবে বাংলাদেশে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি, বিএনপি-র প্রায় চার দশক ধরে প্রধান কান্ডারী ছিলেন যিনি – সেই খালেদা জিয়ার গুরুত্বকে ভারত কখনোই খাটো করে দেখতে পারেনি।

ভারতের দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন মিত্র বলে পরিচিত শেখ হাসিনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার তিক্ততা বা বৈরিতা যতই থাকুক, ভারত কিন্তু তা সত্ত্বেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলাদা সম্পর্ক গড়ে তোলার তাগিদ দেখিয়েছে একাধিকবার।

সেটা হয়তো সব সময় সফলভাবে দানা বাঁধেনি, কিন্তু ভারতের চোখে তা আসলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে খালেদা জিয়ার প্রভাব ও গুরুত্বকেই স্বীকৃতি দিয়েছে।

এবং খালেদা জিয়া তার জীবদ্দশাতেই এটাও দেখে যেতে পেরেছেন, ২০২৪-র ৫ই অগাস্ট-পরবর্তী বাস্তবতায় ভারত কিন্তু বিএনপি-র সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ারও সব প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পাঠাচ্ছে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকেও।

সুতরাং এ কথা স্বচ্ছন্দে বলাই যেতে পারে – খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক যেন এতদিনে একটা পরিপূর্ণ বৃত্ত সম্পূর্ণ করেছে, যার মধ্যে অনেক ওঠাপড়া বা চড়াই-উতরাই ছিল।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, নর্থইস্ট ইন্ডিয়া ফ্যাক্টর
ভারতের ইতিহাসবিদ অনিন্দিতা ঘোষাল বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করছেন দীর্ঘদিন ধরে।

তাঁর বলতে কোনো দ্বিধা নেই বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বর্ণময় ও প্রভাবশালী চরিত্রগুলোর মধ্যে খালেদা জিয়া অবশ্যই অন্যতম, আর ভারতও সেটা জানে।

"তবে আমি ভারতে যেটা লক্ষ্য করেছি, আমরা এখানে খালেদা জিয়ার শাসনামলটাকে বাংলাদেশে তার আগের বা পরের শাসনকালগুলোর সঙ্গে সব সময় তুলনা করে ফেলি!"

"আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আমরা দেখে এসেছি বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয়গান হিসেবে।"

"কিন্তু খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমান যে দলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ও পরে মিসেস জিয়া যে দলের হাল ধরেছিলেন – সেই বিএনপি প্রবর্তন করেছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা, যার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ইসলামি আইডেন্টিটি-টাও।"

"এর মধ্যে হয়তো তথাকথিত ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে ভেঙে বেরিয়ে আসার একটা চেষ্টাও নিহিত ছিল – কিন্তু এই বিষয়টাই ভারতের মুক্তিযুদ্ধ-কেন্দ্রিক বাংলাদেশ কনসেপ্টের সঙ্গে তাঁর একটা পাকাপাকি দূরত্ব তৈরি করেছিল", বিবিসিকে বলছিলেন অধ্যাপক ঘোষাল।

অনিন্দিতা ঘোষাল আরও জানাচ্ছেন, খালেদা জিয়ার সম্বন্ধে ভারতের অস্বস্তি বা সন্দেহ তৈরি হওয়ার আরও একটা বড় কারণ হলো উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে তাঁর অনুসৃত কিছু নীতি।

অধ্যাপক ঘোষাল বলছিলেন, "ভারত মনে করে উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কিছু সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী তার আমলেই বাংলাদেশে অবাধে ঘাঁটি বানাতে পেরেছে এবং তাদের সক্রিয়তা চালিয়ে যেতে পেরেছে।"

"তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসনের সমস্যা উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেকগুলো রাজ্যে এমন আশঙ্কার সৃষ্টি করেছিল যে তারা মনে করেছিল এতে ওই রাজ্যগুলোর জনবিন্যাস পর্যন্ত বদলে যেতে পারে।"

ভারতের সার্বিক স্থিতিশীলতার জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতের গুরুত্ব দিল্লির কাছে চিরকালই অপরিসীম।

কিন্তু এই সংবেদনশীল এলাকাটিকে ঘিরে খালেদা জিয়ার আমলে রীতিমতো টানাপোড়েন ছিল বলেই ভারত তাকে হয়তো কখনো পুরোটা ভরসা করে উঠতে পারেনি, মনে করেন অনিন্দিতা ঘোষাল।

সহজ, স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রথম মেয়াদে
খালেদা জিয়া দুটি পূর্ণ মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, প্রথমটি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ – আর পরেরটি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত।

এর মধ্যে প্রথম মেয়াদে ভারতের সঙ্গে তার সরকারের সম্পর্ক মোটামুটি সহজ ও স্বাভাবিকই ছিল।

ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ ভিনা সিক্রির কথায়, "আসলে খালেদা জিয়া যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হলেন, তার আগের দীর্ঘ প্রায় ষোলো বছর বাংলাদেশ ছিল কার্যত সামরিক শাসনের অধীনে।"

"সেই জায়গায় খালেদা জিয়া যখন সাধারণ মানুষের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলেন, তখন ভারত সেটাকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের একটা 'রিফ্রেশিং মোমেন্ট' হিসেবে দেখেছিল – মানে একটা নতুন সূচনার উন্মেষ।"

"বস্তুত জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতে খালেদা ও হাসিনা দুজনেই সামিল ছিলেন – ভারতের জন্য সেটাও ছিল আশাব্যঞ্জক একটা লক্ষণ!"

ভিনা সিক্রি আরও জানাচ্ছেন, প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরের বছরই (১৯৯২) খালেদা জিয়া কিন্তু 'রীতিমতো খোলা মনেই' দ্বিপাক্ষিক সফরে ভারতে এসেছিলেন।

সেই সফরে দিল্লি ও ঢাকার যৌথ বিবৃতিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল, যা এর আগে বা পরে কোনও দ্বিপাক্ষিক ঘোষণাপত্রে কখনোই করা হয়নি।

অবৈধ অনুপ্রবেশকে ভারত যেহেতু বিরাট একটা ইস্যু বলে মনে করে, তাই খালেদা জিয়া সরকারের এই অবস্থানকে ভারত ব্যাখ্যা করেছিল এভাবে – যে তারা এখন অন্তত এটিকে একটা সমস্যা বলে স্বীকার করছে।

বাস্তবে অবশ্য পরে সেই 'সমস্যা'র সমাধান খোঁজায় অগ্রগতি কিছুই হয়নি, এবং খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদের শেষ দিকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে নানা অস্বস্তি দেখা দিতে শুরু করে।

১৯৯৫-র গোড়ার দিকে ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন দেব মুখার্জি, ফলে তিনি খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদের শেষ বছর দেড়েক তার কার্যকালকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন।

"দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি সে সময়কার বহু স্পর্শকাতর ঘটনা বা দৃশ্যের সাক্ষী, যেগুলো আজও শেয়ার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়", বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

কিন্তু দেব মুখার্জি সেই সঙ্গেই জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার অবশ্যই বড় একটা অবদান ছিল – যেটাকে ভারতও স্বীকার করত।

"যেমন ধরুন, আপনি যদি বিএনপি দলটার দিকেই তাকান দেখবেন নানা ধরনের মতবাদ আছে সেখানে ... চরম বামপন্থী ঘরানার লোকজন যেমন আছেন, তেমনি চরম দক্ষিণপন্থী মতবাদে বিশ্বাসীরাও আছেন।"

"এই এত ধরনের মত ও পথের লোকজনকে তিনি যে সারা জীবন এক ছাতার তলায় রাখতে পেরেছিলেন এটা তার একটা বিরাট বড় কৃতিত্ব।"

তবে এটাও বলার যে খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি – বা বড় কোনো দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানও পাওয়া যায়নি।

অথচ ১৯৯৬তে তিনি বিদায় নেওয়ার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, তারা মাত্র তিন-চার মাসের ভেতর ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি সেরে ফেলে – যা ফারাক্কা বাঁধ-জনিত সমস্যার মোটামুটি একটা সমাধান দিতে পেরেছে বিগত তিন দশক ধরে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ১৯৯৬তে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই খালেদা জিয়া তার ভারত-বিরোধী রাজনীতির সুর আরও সচেতনভাবে চড়াতে শুরু করেন – এবং এই পর্বেই ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া বা টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতার মতো বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি লাগাতার আন্দোলন ও ক্যাম্পেইন চালাতে শুরু করে।

দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতের জন্য 'সমস্যার পাহাড়'
২০০১ সালের অক্টোবরে খালেদা জিয়া যখন দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলেন, তিনি একটি চার দলীয় জোট সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এবং সেই জোটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শরিক ছিল জামায়াতে ইসলামী।

মতিউর রহমান নিজামী, আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মতো জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তার ক্যাবিনেটে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পেয়েছিলেন।

খালেদা জিয়ার এই মেয়াদের অনেকটা সময় (২০০৩-২০০৬) ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রদূতের ভূমিকায় ছিলেন ভিনা সিক্রি, তিনি বলছিলেন, এই জামাত সংশ্লিষ্টতার কারণেই ভারত তাকে তখন আর বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না।

মিস সিক্রি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "জামায়াতের কারণেই হোক বা অন্য কারণে, খালেদা জিয়ার সেই সরকারে পাকিস্তানের প্রভাব ছিল মারাত্মক বেশি – যা ভারতের পক্ষে কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।"

"মনে রাখতে হবে তার এই আমলেই বাংলাদেশে জেএমবি-র উত্থান শুরু হয়. কিংবা বাংলাভাই-য়ের মতো চরম মৌলবাদী লোকজন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার সরকার কিন্তু সব দেখেশুনেও চোখ বন্ধ করে ছিল!"

"তারপর আমি ঢাকায় দায়িত্ব নিয়ে যাওয়ার পরের বছরই এমন দুটো ঘটনা ঘটলো, যা ভারতের সেই সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। এর একটা হল চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি থেকে দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা, আর দ্বিতীয়টা শেখ হাসিনার ওপরে গ্রেনেড হামলা!"

ভারত এখনও বিশ্বাস করে চট্টগ্রামের জেটি থেকে উদ্ধার হওয়া ওই সব অস্ত্রশস্ত্র আলফা-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর জন্যই পাঠানো হচ্ছিল।

প্রসঙ্গত, বন্দরের সেই জেটি ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন, আর তখন শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী।

খালেদা জিয়ার সরকার আলফা-র মতো এই ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে, ভারত সে সময় দিনের পর দিন বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এই অভিযোগ তুলে ধরেছে – কিন্তু বাংলাদেশ তাদের মাটিতে এই গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ত্ব কখনো স্বীকারই করেনি।

অথচ পরেশ বড়ুয়া, অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো শীর্ষস্থানীয় আলফা নেতারা তখন ঢাকায় সরকারি আতিথেয়তায় রীতিমতো পরিবার নিয়ে বাস করছেন বলে ভারতের গোয়েন্দারা দাবি করছিলেন।

ভিনা সিক্রি তাই মনে করেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে দিল্লির যে একটা স্বাভাবিক উদ্বেগ ছিল – খালেদা জিয়া তার দ্বিতীয় মেয়াদে সেটাকে আমলে নেননি বলেই দু'পক্ষের সম্পর্কে এতটা অবনতি হয়েছিল।

ভিনা সিক্রির কথায়, "ওই মাত্র কয়েক বছরেই বাংলাদেশে আমাদের জন্য কার্যত একটা সমস্যার পাহাড় তৈরি হয়ে গিয়েছিল।"

খালেদা জিয়ার এই দ্বিতীয় পূর্ণ প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদটাই যে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় ('হিস্টোরিক লো') সেটাও মনে করেন মিস সিক্রি ।

'রিয়ার ভিউ মিরর' এবং অত:পর
২০০৯ সালের শুরুতে ক্ষমতায় শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের পর দিল্লি ও ঢাকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নাটকীয় উন্নতির লক্ষণ দেখা যেতে থাকে, আর ততই ভারতের দূরত্ব বাড়তে থাকে খালেদা জিয়া ও তার দলের সঙ্গে।

খালেদা জিয়ার আমলে প্রধান সমস্যার জায়গাটা যেখানে ছিল, সেই উত্তর-পূর্ব ভারতে দিল্লির নিরাপত্তাগত উদ্বেগের ক্ষেত্রগুলো অ্যাড্রেস করাটা শেখ হাসিনার এই পরিবর্তন আনার পেছনে বড় কারণ ছিল– এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা মোটামুটি সবাই একমত।

শেখ হাসিনার সেই মেয়াদেই অরবিন্দ রাজখোয়া বা অনুপ চেতিয়ার মতো আলফা নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়, বাংলাদেশের মাটিতে শিবির গোটাতে বাধ্য হয় উত্তর-পূর্বের একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী।

তখন বিএনপি-র সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে শৈত্য থাকলেও বাংলাদেশে পরের নির্বাচনের বছরখানেক আগে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানায় মনমোহন সিংয়ের সরকার। সেই সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মন:পূত না হলেও তা কিন্তু উপেক্ষা করা হয়েছিল।

২০১২-র অক্টোবরে খালেদা জিয়ার সেই সফর অনুষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, একান্ত বৈঠক হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গেও।

বিএনপি আমলের 'ট্র্যাক রেকর্ড' জানা থাকা সত্ত্বেও ভারত কেন খালেদা জিয়ার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবে তখন দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন বলেছিলেন, "বন্ধুত্বের গাড়ি এখন সামনের দিকে চলতে শুরু করেছে!"

"পেছনে যা ঘটার ঘটে গেছে। কিন্তু আমরা এখন আর সেটা দেখার জন্য রিয়ার ভিউ মিররে তাকাতে রাজি নই!"

দিল্লিতে খালেদা জিয়ার সেই সফরের পর অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ভারত ও বিএনপি-র মধ্যে আবার একটা স্বাভাবিক 'ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ' (কাজের সম্পর্ক) গড়ে উঠতেই পারে এবং সে প্রক্রিয়া হয়তো শুরুও হয়ে গেছে।

পরের নির্বাচনে বিএনপি-র সাফল্যের সম্ভাবনাই যে ভারতের ওই পদক্ষেপকে প্রভাবিত করেছিল, সন্দেহ নেই তাতেও।

কিন্তু দিল্লিতে খালেদা জিয়ার সেই গুরুত্বপুর্ণ সফরের মাত্র চার মাসের মাথায় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যখন বাংলাদেশে গেলেন, তাঁর সঙ্গে বিরোধী নেত্রীর আলাদা বৈঠক নির্ধারিত থাকলেও শেষ মুহুর্তে মিসেস জিয়া সে বৈঠক বাতিল করে দেন।

বৈঠক বাতিল করার কারণ হিসেবে বিএনপি হরতালের সময় 'নিরাপত্তা ঝুঁকি'র কথাই বলেছিল – কিন্তু ভারতের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর পরামর্শেই খালেদা জিয়া ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্যন্ত এড়িয়ে গিয়েছেন।

এই ঘটনার পরই খালেদা জিয়া ও ভারতের সম্পর্ক আবার সেই আগের শীতল অবস্থায় ফিরে যায়, ইংরেজিতে যাকে বলে 'ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান'!

খালেদা-ভারত সম্পর্কে জামায়াত ফ্যাক্টর
বস্তুত খালেদা জিয়ার দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ সংস্রবই ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বরাবর বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে – কারণ জামায়াতকে বিভিন্ন কারণে ভারত চিরকাল তাদের জন্য 'রেড লাইন' বলেই গণ্য করে এসেছে।

ভারতে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, আর কোনো কারণে না হোক - বাংলাদেশে সহজ নির্বাচনী পাটিগণিতের জন্যই খালেদা জিয়া ভোটের ময়দানে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে চলার পক্ষপাতী ছিলেন।

কিন্তু ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তাঁর দলের সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি নেতৃত্বের একটা অংশের ধারণা ছিল এই নতুন সরকারের সঙ্গে তাদের একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি হতে পারে – কিন্তু বাস্তবে সে রকম কিছু ঘটেনি।

পরবর্তী কয়েক বছর ধরে বিএনপি-র বিভিন্ন স্তরের নেতারা অনানুষ্ঠানিক সফরে বহুবার দিল্লিতে এসে বিজেপি ও আরএসএস নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করেছেন, ভারত-বিরোধিতার সুর নরম করারও আভাস দিয়েছেন – কিন্তু তাতে বরফ গলেনি।

বরফ অবশেষে গলল ২০২৪-র ৫ অগাস্টে বাংলাদেশে নাটকীয় পালাবদলের পর, যখন ভারত অনুধাবন করল যে বাংলাদেশে তাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্র শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা এই মুহুর্তে আর নেই বললেই চলে।

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস মনে করেন, ৫ অগাস্টের পর যেভাবে জামায়াত ও বিএনপি-র দূরত্ব ক্রমেই বেড়েছে – তাতেও ভারতের জন্য বিএনপি-র কাছাকাছি আসার এই প্রক্রিয়া অনেকটা সহজ হয়েছে।

তিনি বিবিসি বাংলাকে জানাচ্ছেন, বিএনপি যদি ভারত সম্বন্ধে তাদের নীতিটা কী – সেটা স্পষ্ট করে বলে, তাহলে এতদিনের পারস্পরিক অবিশ্বাস এখনও অনায়াসেই দূর হতে পারে।

গত কয়েক মাসে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবেও একাধিকবার বলেছে, বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচনে যারাই জিতে ক্ষমতায় আসবে তাদের সঙ্গে 'এনগেজ করতে' তারা প্রস্তুত।

এই 'যারাই' বলতে যে বিএনপিকে বোঝানো হচ্ছে (এবং অন্য আর কেউ নয়) – সেটা মোটা দাগে দিল্লিতে সবারই জানা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক তথা ভারতের ক্যাবিনেট সচিবালয়ের সাবেক কর্মকর্তা শান্তনু মুখার্জিও বিবিসিকে বলছেন, "নির্বাচিত একটি বিএনপি সরকার যদি শুধু ভারতের সিকিওরিটি কনসার্নগুলো অ্যাড্রেস করে, তাহলে তাদের সঙ্গে দিল্লির স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি না হওয়ার কোনো কারণই নেই!"

দু'পক্ষের মধ্যে ঘরোয়া স্তরে কথাবার্তার প্রক্রিয়া ও পরস্পরকে জানা ও বোঝার এই চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই – এবং লক্ষ্যণীয় হল, খালেদা জিয়া বেঁচে থাকতেই সেটা দেখেও যেতে পেরেছেন।

খালেদা জিয়ার চার দশকেরও বেশি সময়-ব্যাপী রাজনৈতিক পথচলায় ভারতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তাই একটি আকর্ষণীয় বৃত্ত সম্পূর্ণ করেছে, এটা বললে বোধহয় খুব একটা ভুল হবে না!