Image description

দীর্ঘ ১৭ বছরের বেশি সময়ের নির্বাসিত জীবন ছেড়ে দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত বৃহস্পতিবার রাজসিক সংবর্ধনার মাধ্যমে দেশবাসী তাঁকে বরণ করে নিয়েছে। দেশে ফিরে তিনি বসে থাকেননি। নিরাপত্তাঝুঁকি থাকলেও গত দুই দিন তিনি মিশেছেন জনস্রোতে।

যাচ্ছেন জনগণের মাঝে। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। বাবা ও ভাইয়ের পাশাপাশি ২৪-এর জুলাই গণ-আন্দোলনের সম্মুখ সারির যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির কবরও জিয়ারত করেছেন। তারেক রহমান এখন চ্যালেঞ্জ জয়ের মিশনে নেমেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সামনে যেহেতু ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তাই নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকির কথা তিনি নিজেই জানিয়েছেন। তাই সাধারণভাবে চলাচল করলেও নিজের নিরাপত্তার কথা তাঁকে ভাবতে হবে।

আগামী নির্বাচনে জয়ের জন্য বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থা আরো বাড়াতে হবে। বিরোধী পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত সমালোচনা বা চাপ আসতে পারে, সেগুলো সামাল দিতে হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কূটনৈতিক পর্যায়ে অবস্থান আরো জেরদার করতে হবে। এর পাশাপাশি বিএনপির সাংগাঠনিক নিয়ন্ত্রণ আরো শক্ত করতে হবে।

গত বৃহস্পতিবার তারেক রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।

তিনি অল্প কথা বললেও এর মধ্যেই বিএনপির রাজনীতিতে কৌশলগত রূপান্তরের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারেক রহমান সংঘাত থেকে ঐক্য, প্রতিশোধ থেকে পুনর্গঠন, দলীয় রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রচিন্তার কথা বলেছেন। শুধু দলীয় নেতা হিসেবে নয়, নিজেকে জাতীয় নেতৃত্বের ভূমিকায় প্রস্তুত করছেন।

 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, তারেক রহমানের বক্তব্য ইতিবাচক। তিনি সবাইকে নিয়ে চলতে চান। তিনি তরুণদের কথা বলেছেন। আগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথা বলেছেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বক্তব্যেও তিনি তাঁর প্ল্যানের কথা বলেছেন। এখন নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে যদি তাঁর দল ক্ষমতায় যায়, তখন তিনি আজকের এই কথাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন কি নাসেটাই হলো বিবেচ্য বিষয়। নির্বাচনের আগে ও পরে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বপ্রথম চাটুকারিতা পরিহার করতে হবে। তাঁকে সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ তাঁর ওপরই জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

তারেক রহমান দেশে ফেরার পর এয়ারপোর্ট থেকে রাজধানীর ৩০০ ফিট সড়কের ১০ মিনিটের পথ পৌঁছতে তাঁর সোয়া তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে। পরদিন শুক্রবার তিনি জুমার নামাজের পর প্রথমে গুলশানের বাসা থেকে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান। বিকেলে তিনি সেখানে পৌঁছতে পারলেও স্মৃতিসৌধে পৌঁছতে রাত ১০টা বেজে যায়। মূলত বিএনপি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসার ভিড় ঠেলে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে তাঁকে বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি যেখানেই যাচ্ছেন, লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটছে।

গতকাল পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে তারেক রহমান ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদির কবর জিয়ারত করেন। কিন্তু গত শুক্রবার রাত থেকে ওসমান হাদির হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে অবস্থান নেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যরা। এর পরও তিনি তাঁর কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনেননি। অবশ্য তাঁর আগমন উপলক্ষে ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যরা কিছু সময়ের জন্য শাহবাগ মোড় থেকে সরে যান।

বিএনপি নেতারা বলছেন, তারেক রহমান দেশে আসার পর বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থা আরো বেড়েছে। সবাই তাঁকে আগামী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই ভাবছেন। এর পরও তিনি কিন্তু সাংগঠনিকভাবে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিএনপি সাত হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী দিনেও তা অব্যাহত থাকবে। এত দিন যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল, তারেক রহমান দেশে ফেরার পর তা অনেকটাই দূর হয়েছে। জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে। বিরোধীপক্ষের সমালোচনা বা চাপ থাকলেও তিনি ঐক্যের কথা বলেছেন, যা সাধারণ মানুষ খুবই ভালোভাবে গ্রহণ করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম গত শুক্রবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে হওয়া নিয়ে যে সংশয় ছিল, তা দূর হয়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে সমালোচকদের যত সংশয় ছিল, তা মুছে দিয়েছে গত বৃস্পতিবারের ঘটনা (তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন)। রেকর্ড ভঙ্গকারী জনতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে শুভেচ্ছা জানাতে জড়ো হয়। এটি একটি নির্বাচনের জন্য দেশের প্রস্তুতির একটি স্পষ্ট প্রমাণ ছিল।

জানা যায়, নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণেও বিএনপি অনেকখানি এগিয়ে আছে। তারা তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করা শরিক দলগুলোর জন্যও আসন ছেড়েছে। বিভিন্ন দল থেকে বেশ কয়েকজন নেতা এরই মধ্যে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁদেরও আসন দিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া প্রতিটি আসনে বিএনপির একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও একজনকেই মনোনয়ন দিতে হয়েছে। এ জন্য কিছু নেতার মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও তারেক রহমান দেশে ফেরার পর তা অনেকটাই মিটে গেছে। তাঁর নির্দেশের বাইরে দলের কোনো নেতা যাবেন না বলে মনে করা হচ্ছে। সবাই শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধানের শীষের পক্ষেই কাজ করবেন।

জানা যায়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও বিএনপি বেশ জোর দিয়েছে। আগে থেকেই দলটির বেশ কিছু বন্ধু রাষ্ট্র ছিল, তারা পুুরোপুরি সহায়তা করছে। বিএনপি বরাবরই ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট। এবার তারা একই নীতি বজায় রাখছে। ফলে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের চ্যালেঞ্জেও বিএনপি অন্য সব দলের চেয়ে এগিয়ে আছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এত দিন দেশে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা ছিল, তারেক রহমান দেশে আসার পর তা পূরণ হয়েছে। মানুষের দায়বদ্ধতার জন্য যে গুণাবলি প্রয়োজন, তা তাঁর মধ্যে আছে। পরিস্থিতির কারণে তিনি প্রায় দেড় যুগ লন্ডনে ছিলেন, এর মধ্য দিয়ে তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক পরিপক্বতা বেড়েছে। তিনি দেশের বাইরে থেকেও দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। সবার সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রেখেছেন। অর্থাৎ একজন নেতার যত ধরনের গুণাবলি প্রয়োজন, সবই তারেক রহমানের মধ্যে রয়েছে। আগামী দিনে তাঁর মাধ্যমেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের অন্য সদস্য ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার কালের কণ্ঠকে বলেন, এ দেশের জনগণ দীর্ঘদিন তারেক রহমানকে দেখেনি। তিনি আসার পর নেতাকর্মীরা বাড়তি অ্যাকটিভ হয়েছে। কারণ সবাই বুঝে গেছে, দলের জন্য, দেশের জন্য কাজ না করলে টিকে থাকা যাবে না। তারেক রহমান বলেছেন, তাঁর একটা প্ল্যান আছে, তিনি আগেও নানা পরিকল্পনার কথা বলেছেন। যেগুলো মানুষ খুবই ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। তারেক রহমান সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চান। এখন সবাই যদি একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে সব চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করা সম্ভব।