Image description
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্ততি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক দলগুলোও এখন নির্বাচনমুখী। পাশাপাশি অনেক জল্পনা-কল্পনার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দেশে ফিরেছেন। তারপরেও নির্বাচন নিয়ে কেন যেন অনিশ্চয়তা দূর হচ্ছে না। প্রকাশ্যে না হলেও পর্দার আড়ালে এখনো বলা হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। দেশে ফেরার দিন তারেক রহমান নিজেই এই বিষয়ে কথা বলেছেন। ওই দিন বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, আধিপত্যবাদী শক্তির গুপ্তচররা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রে এখনো লিপ্ত রয়েছে। শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কাটলেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এসব বক্তব্য এবং দলগুলোর তৎপরতায় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাই ইঙ্গিত করে। তাদের মতে, প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন এখনো শতভাগ নিশ্চিত হয়নি। এনসিপিতে ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে। প্রায় সব আসনে মনোনয়ন ঘোষণা করেছে বিএনপি। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক আসনেই সবচেয়ে বড় দল বিএনপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কতজন দাঁড়ায় সেদিকে তাকিয়ে আছে রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা। প্রশ্ন আছে, সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্রোহীদের প্রার্থিতা শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করতে পারবে কিনা বিএনপি। যদিও তারেক রহমান দেশে ফেরার পর বিএনপিতে অনৈক্য প্রায় নেই বললেই চলে। তবুও বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় তার জন্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বিএনপির প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা একত্রিত হয়ে ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে নির্বাচন করবেন, নাকি তারা নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে লিপ্ত হবেন, তা নিয়েও রয়েছে নানা শঙ্কা। এমন আলোচনায় বলা হচ্ছে, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন এককভাবে শেখ হাসিনার হাতে ছিল। ফলে প্রশাসনের প্রভাব খাটিয়ে তিনি যাকে খুশি জিতিয়েছেন, যাকে খুশি হারিয়েছেন। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনে সেই সুযোগ এককভাবে বিএনপির হাতে থাকবে না বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে বিএনপিতে বিভেদ থাকলে অন্য দলগুলো সেই সুযোগ নেবে বলে আলোচনা আছে। একই কারণে শরিক দলগুলোর জয় নিশ্চিত করাও বিএনপির জন্য কিছুটা কঠিন হবে বলে অনেকে মনে করছেন।

এছাড়া নির্বাচনে জামায়াত ও বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সংঘাত হয় কিনা, এ নিয়েও দেশের রাজনীতিতে রয়েছে নানা আলোচনা। ওই ধরনের সংঘাতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ আলোচনা হচ্ছে; শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের পরে দেশে নতুন ধরনের এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ইনকিলাব মঞ্চের ব্যানারে শাহবাগে লাগাতার কর্মসূচি চলছে। যদিও হাদি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি দেশের সব মানুষের। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শনিবার তার কবর জিয়ারত করেছেন। এর আগে ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরে সংবর্ধনা সভায় হাদিকে স্মরণ করে তিনি বক্তব্য রাখেন। এছাড়া হাদি হত্যাকাণ্ডে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ১৭ দিনেও হাদি হত্যার মূল আসামিকে গ্রেফতার করা যায়নি। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে হত্যাকারী বিদেশে চলে গেছে কিনা এখনো সেটি পরিষ্কার করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে ৩০০ আসনের নির্বাচন একসঙ্গে সরকার কীভাবে সামাল দেবে এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে।

এদিকে, হাদি হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ বেশকিছু দাবিতে ৩ জানুয়ারী মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সমাবেশ ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। ধারণা করা হচ্ছে, মূলত রাজনৈতিক শোডাউনের জন্য ওই সমাবেশ ডাকা হচ্ছে। অনেকের সন্দেহ, শাহবাগের চলমান শোডাউনের নেপথ্যেও জামায়াতের ভূমিকা থাকতে পারে। উদ্দেশ্য হলো-একদিকে সরকারকে চাপে রাখা। অন্যদিকে, বিএনপিকেও লোকসমাগম দেখানো। কারণ তারেক রহমান দেশে ফেরার পর গত ৩ দিনে দেশের রাজনীতি অনেকটা ‘তারেকময়’ হয়ে উঠেছে। সবকিছুই হচ্ছে তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে। তার কর্মসূচিই প্রচার পাচ্ছে। সেই তুলনায় জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর তৎপরতা কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। ফলে বিএনপির বিপরীতে জামায়াত নানা মোড়কে শোডাউন করতে পারে বলে অনেকে সন্দেহ করছেন।

বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বলছে। তবে দলটির প্রস্তুতি ততটা জোরালো বা দৃশ্যমান নয়। পর্দার আড়ালে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের তৎপরতা মোটেই থেমে নেই। ফলে তারা (আওয়ামী লীগ) আসন্ন নির্বাচনে কি ভূমিকা পালন করে সেটিও দেখার বিষয়। এছাড়া নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আছে বলে রাজনৈতিক দলগুলোই অভিযোগ করে আসছে।

রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্বাচনি পরিবেশ বজায় রাখা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেন কোনো সহিংসতা ও মারামারি না হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এর বাইরে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ আমি আপাতত দেখি না। তিনি আরও বলেন, সেক্ষেত্রে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্তভাবে নির্দেশ দিতে হবে। তবে সরকার সেটি পুরোপুরিভাবে করছে না বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য এই মুহূর্তে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার। যুগান্তরকে তিনি বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের আগেই অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো হয়; এবার এটা আরও বেশি জরুরি ছিল। কারণ গণ-অভ্যুত্থানের সময় কারাগার ও থানাগুলো থেকে প্রচুর অস্ত্র গুলিসহ লুট হয়ে গেছে। তার বড় অংশই এখনো উদ্ধার হয়নি। আলতাফ পারভেজ বলেন, অস্ত্র চালানোয় অভিজ্ঞ অনেক অপরাধী কারাগার থেকে বাইরে বেরিয়েছে। ফলে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষিত জনবল দুটোই মাঠে রয়ে গেছে। কিন্তু এবার সেভাবে অভিযান দেখছি না। তিনি আরও বলেন, গত ১৬-১৭ মাসে নির্বাচন বিলম্বিত করা বা নির্বাচন হতে না দেওয়ার যে একটা অদৃশ্য, অপ্রকাশ্য শক্তির প্রচেষ্টা ছিল-সেটা এখনো নির্মূল হয়ে যায়নি। সেটা নানা ফর্মে এটি আরও কিছু দিন চলবে। তবে আমার মনে হয় নতুন বছরে সেটা দুর্বল হয়ে যাবে।

নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কেটে গেছে, তবে ষড়যন্ত্র এখনো রয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার সকালে গুলশানে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র তো আগে থেকে সব বলা যায় না। তবে তারেক রহমানের দেশে ফেরায় নির্বাচনের ষড়যন্ত্র অনেকটাই কেটে গেছে। আগামী দিনে যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তখন নিঃসন্দেহে তারেক রহমান সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক সফলতা অর্জন করবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

জামায়াত নির্বাচনের জন্য মাঠে থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে এখনো চ্যালেঞ্জ দেখছে দলটি। জানতে চাইলে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার একদিকে ঝুঁকে পড়েছে এমন অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে লন্ডন বৈঠকের ধারাবাহিকতা আছে। এটা আরও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এই জায়গায় থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন এখন হুমকির মুখে আছে। সেই কারণে আমরা সরকারের কাছে বারবার দাবি জানাচ্ছি-লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। সরকার যে রাজনৈতিক নেতাদের প্রটোকলের নামে প্রশাসনকে প্রভাবিত করছে, এখান থেকে সরে আসতে হবে।

তিনি বলেন, প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে সরকার নির্দেশ নিয়েছে বিলবোর্ড, পোস্টার সরিয়ে নিতে হবে। জামায়াত নিজ দায়িত্বে তাদেরগুলো সরিয়েছে। তবে এখনো কিছু কিছু দলের বিলবোর্ড, পোস্টার শোভা পাচ্ছে। এখানে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে এখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হচ্ছে না। এছাড়া অস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাসীরা গ্রেফতার হচ্ছে না। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক প্রটেকশনে নির্বাচনি কাজ করছে বলেও অভিযোগ করেন হামিদুর রহমান আযাদ। তার মতে, এসব ঠিক না হলে জনগণ যে নির্বাচন আশা করে, সেই নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা দেখছে জামায়াত।

বিপ্লবী ওয়ার্কাস পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আছে। বিশেষ করে হাদি হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এতে প্রার্থী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ফলে প্রার্থীর নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এটাকে মোকাবিলা করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা যেন বলপ্রয়োগ ও সহিংসতায় পরিণত না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। এটি করা সম্ভব হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আস্থা তৈরি হবে। এছাড়া সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। এখন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে গেলে সরকারের নিরপেক্ষতা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে হবে। সেদিক থেকে সরকার, নির্বাচন কমিশন, জনগণ সবাইকে পরস্পরের আস্থার মধ্যে নেওয়ার দরকার। নির্বাচন কোনো কারণে যদি বিতর্কিত হয়, তাহলে সরকার ও পরবর্তী সংসদও বিতর্কিত হবে। ১৭ বছর পরে বিতর্কিত নির্বাচন আমরা চাইব না।

এছাড়াও অন্তত ৫টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা যুগান্তরকে জানান, দেশে নির্বাচনি আমেজ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনি তৎপরতা দৃশ্যমান থাকলেও অদৃশ্য একটি আতঙ্কও রয়েছে। তারা বলেন, নির্বাচন বানচাল করতে দেশি-বিদেশি নানা অপশক্তি বিভিন্ন ভাবে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন তাদের কাছেও চ্যালেঞ্জ। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐক্য দেখা যাচ্ছে না। নানা ভাবে একেক সময় একেক বক্তব্য দিচ্ছেন নেতারা। এ কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বড় বাধা হিসাবেও দেখছেন তারা।