আর মাত্র তিন দিন পরেই শুরু হবে নতুন শিক্ষাবর্ষ। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ ও পাঠদান শুরু করতে অপেক্ষায় আছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের প্রায় তিন কোটি শিক্ষার্থী। অথচ মাধ্যমিক স্তরের ৪০ শতাংশের বেশি বই এখনো প্রস্তুত করতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বই ছাপানোর সক্ষমতা নেই এমন কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে এবারও কাজ দেওয়ায় বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে তারা বই দিতে পারছে না। এছাড়া এনসিটিবির নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও পুনরায় দরপত্র আহ্বান করার কারণে বই ছাপানোর কাজ বাঁধাগ্রস্ত হয়।
এবার স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যের প্রায় ৩০ কোটি বই ছাপানোর কথা। এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই ছাপতে হবে ২১ কোটিরও বেশি। এর মধ্যে সাড়ে আট কোটি বই এখনো সরবরাহের জন্য প্রস্তুতই হয়নি। ফলে বছরের শুরুতেই সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পাচ্ছেন না। এতে পড়াশুনায় ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন তারা। এর নেপথ্যে রয়েছেন এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক)। যদিও এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মো. সাহতাব উদ্দিন বলছেন, তারা নতুন বছরের শুরুতেই সব শিক্ষার্থীকে বই দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
তিনি স্বীকার করেন, মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সব বই দেওয়া সম্ভব হবে না। ‘মাধ্যমিকের তিন শ্রেণির বই ছাপানোর কাজের জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বান করায় বই ছাপাতে একটু দেরি হচ্ছে’-জানান তিনি।
দরপত্রের অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে চলতি বছর ১৯ আগস্ট মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম-এই তিন শ্রেণির বই ছাপাতে দরপত্রের অনুমোদন দেয়নি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। ওইদিন কমিটির ৩২তম সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জানা যায়, ঢাকা মাতুয়াইল সোহাগী প্রিন্টার্স মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির ১৮ লটের বই ছাপানোর কাজ পায়। এসব লটের বইয়ের পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ। প্রতিষ্ঠানটি বই ছাপানোর ছয়টি সিট মেশিনের কথা উল্লেখ করে কাজ বাগিয়ে নিলেও একটি মাত্র সিট মেশিন রয়েছে তাদের। গজ মেশিন আছে একটি। এসব কারণে বলিয়াম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির ছাপানোর কাজের সক্ষমতা অনেক কম। এতে যথাসময়ে বই ছাপানোর কাজ শেষ করতে পারছে না সোহাগী প্রিন্টার্স।
অন্যদিকে, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে আমাজন প্রিন্টিং প্রেস মাধ্যমিকের তিন লটের প্রায় দুই লাখ বই ছাপানোর কাজ পায়। এনসিটিবির মনিটরিং কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। প্রতিষ্ঠানটির যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে শোকজ করা হয়েছে।
একইভাবে পুরান ঢাকার সূত্রাপুর হোমায়রা প্রিন্টার্স নবম শ্রেণির ছয় লটের কাজ পায়। বই ছাপানোর সব ধরনের সক্ষমতা না থাকলেও কাজ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ছাড়া আবু বকর আর্ট প্রেসসহ পুরান ঢাকার মুদ্রণ কাজ পাওয়া অন্তত ৮০ ভাগ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে-যাদের প্রেস আকারে ছোট, কাটিং ও বাইন্ডিং মেশিন নেই। রয়েছে পরিবেশগত নানা সমস্যা। এক কথায় নিয়ম অনুযায়ী তাদের বই ছাপানোর কাজ পাওয়ার কথা নয়। তারাও কাজ পেয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ‘ম্যানেজ’ করে বই ছাপানোর কাজ পাওয়ায় তারা নির্ধারিত সময়ে বই দিতে পারছে না। সূত্র জানায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের মান নিশ্চিত করতে ইন্সপেকশন টিম নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এই ইন্সপেকশন টিম অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে কিছু নির্দিষ্ট পেপার মিল থেকে কাগজ ক্রয় করতে বাধ্য করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সঠিক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে বাছাইয়ে ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এমনকি ইন্সপেকশন টিম গঠনেও তিনি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেননি। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে এ ধরনের কাজ করছেন বলে যে অভিযোগ আছে সে বিষয়ে জানতে ফোন করলেও সাড়া দেননি। মেসেজ করলেও উত্তর দেননি। গেল বছরও তার কারণে তিন মাস দেরিতে বই পায় শিক্ষার্থীরা।
আগামী বছর বিনামূল্যে বিতরণের জন্য মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ২১ কোটি ৪০ লাখ বই ছাপানোর কথা। যেসব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সময় মতো বই পাচ্ছেন না এর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের সংখ্যা চার কোটি ৪৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৬, সপ্তম শ্রেণির চার কোটি ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯২ এবং অষ্টম শ্রেণির চার কোটি দুই লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮। দরপত্র বাতিল হওয়া তিন শ্রেণির মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল গত ১৯ মে, সপ্তম শ্রেণির ১৫ মে এবং অষ্টম শ্রেণির ২ জুন। চলতি মাসের ৪ ডিসেম্বর বই ছাপানোর চুক্তি শেষ হয়।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান যুগান্তরকে বলেন, মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৫০ শতাংশ বই এখনো শিক্ষার্থীদের জন্য প্রস্তুত করতে পারেনি এনসিটিবি। যার ফলে সব শিক্ষার্থী বই পাবে না। সক্ষমতা নেই এমন অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান আগে থানা ও উপজেলা থেকে অতিরিক্ত বই কিনে তা সরবরাহ করত। তাদের মেশিন বা অন্যান্য সামগ্রী নেই। ইন্সপেকশন টিম কমিশনের জন্য অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত মিল থেকে কাগজ কিনতে বাধ্য করে। এনসিটিবিকে ম্যানেজ করে তারা এই কাজ করে। এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী বই উৎপাদন ও বিতরণের প্রধান দায়িত্বে রয়েছেন। তার অজান্তে কোনো কিছু হয় না বলেই জানি।
এদিকে আজ (রোববার) নতুন শিক্ষাবর্ষ ২০২৬ এর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তকের অনলাইন ভার্সন উন্মুক্ত করা হবে বলে জানা গেছে। বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের মোট ৬৪৭টি পাঠ্যবই এনসিটিবি ওয়েবসাইটে একযোগে প্রকাশিত হবে।