বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে দেশে ফিরছেন বৃহস্পতিবার। দেশে ফিরে আপাতত তিনি স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) সুবিধা পাচ্ছেন না। তবে তার নিরাপত্তায় ‘কভার্ট অ্যান্ড ওভার্ট’ নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রেড, ইয়েলো ও হোয়াইট-এই তিন জোনে ভাগ করে সাজানো হয়েছে নিরাপত্তা ছক। ইনার কর্ডনে দায়িত্ব পালন করবেন ‘চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স’ (সিএসএফ)-এর সদস্যরা। অন্যদিকে আউটার কর্ডনে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। তার নিরাপত্তায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি মোতায়েন থাকবে সেনাবাহিনীও। খিলক্ষেতের ৩০০ ফুট এলাকার যে স্থানে তারেক রহমানকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে, সেই স্থানটি করা হবে সুইপিং। একই সঙ্গে সুইপিং করা হবে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালও। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তারেক রহমানের মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর এভারকেয়ার হাসপাতালে যাওয়ার কথা রয়েছে তারেক রহমানের। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট এবং সিএসএফ। মঙ্গলবারও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং বিএনপির পক্ষ থেকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত একাধিক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সভা থেকে নিরাপত্তাব্যবস্থাকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-রেড, ইয়েলো ও হোয়াইট জোন। রেড জোনে যারা প্রবেশের সুযোগ পাবেন, তাদের বিশেষ সিকিউরিটি কার্ড দেওয়া হচ্ছে। ওই কার্ড ছাড়া কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না। ইয়েলো জোনের জন্য থাকছে আলাদা কার্ড। যারা এই কার্ড পাবেন, তারাই কেবল ইয়েলো জোনে যেতে পারবেন। রেড ও ইয়েলো জোনের বাইরে যে এলাকা থাকবে, সেটা বিবেচিত হবে হোয়াইট জোন হিসাবে। এই জোনে প্রবেশ করতে পারবেন সাধারণ মানুষ। তারেক রহমানের আগমনের দিন পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার প্রায় ২ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকতে পারে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সোমবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১৮তম সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তারেক রহমানের দেশে নিরাপদ আগমন নিশ্চিত করার জন্য ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকার জননিরাপত্তা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সম্পূর্ণ সতর্ক ও সমন্বিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে অনুষ্ঠানটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
সূত্রমতে, তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তাকে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এসএন নজরুল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা কভার্ট অ্যান্ড ওভার্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছি। পেশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসএসএফ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না তারেক রহমানকে। তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তা পরিকল্পনায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সেখান থেকে এভারকেয়ার হাসপাতাল হয়ে গুলশান পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা এবং তার বাসভবনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তবে চূড়ান্ত নির্দেশনা এখনো জারি হয়নি। ‘কভার্ট অ্যান্ড ওভার্ট’ নিরপত্তাব্যবস্থার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এটি হলো প্রকাশ্য ও গোপনে নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়। প্রকাশ্যে পোশাকধারী এবং গোপনে গোয়েন্দা নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসভবন ও তারেক রহমানের বাসভবন দেওয়ালঘেঁষা হওয়ায় দুটি বাসা এবং তারেক রহমানের অফিসকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিকল্পনার আওতায় আনা হয়েছে। বাসা ও অফিসের মাঝখানের দূরত্ব ও চলাচলের পথকে অতিগুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকেই পুলিশের বিশেষ নজরদারি শুরু হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর রুটজুড়ে প্রতিটি থানা এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হবে। বিশেষ এসকর্টসহ একাধিক চেকপোস্ট থাকবে। সাধারণত গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় ৯টি চেকপোস্ট চালু থাকে। যেখানে সার্বক্ষণিকভাবে ১৫০ জনেরও বেশি পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। তারেক রহমানের আগমন উপলক্ষ্যে চেকপোস্টের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে তার বাসভবনের আশপাশেও।
গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রওনক আলম জানিয়েছেন, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট সমন্বিতভাবে নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে। তবে এখনো চূড়ান্ত নির্দেশনা ঠিক হয়নি। আমরা নির্দেশনা অনুযায়ী সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেব।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে এসএসএফ নিরাপত্তার আবেদন জানিয়েছে দলটি। আবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে অন্তত তিনটি বৈঠক করে অন্তর্বর্তী সরকার। বৈঠকগুলোয় কোনো কোনো কর্মকর্তা অনুরোধের পক্ষে মত দিলেও কেউ কেউ ভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাদের যুক্তি-তারেক রহমান কোনো রাষ্ট্রীয় পদে নেই এবং তিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী বা দলীয় চেয়ারপারসনও নন। বৈঠকগুলোয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিভিআইপি) ও সফররত বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে এসএসএফ। তবে এ তালিকার বাইরে কাউকে এসএসএফ নিরাপত্তা দিতে হলে সাধারণত সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।
গত জুনে তারেক রহমানের জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ি ও বাড়তি নিরাপত্তার আবেদন করেছিলেন বিএনপির কোষাধ্যক্ষ রশিদুজ্জামান মিল্লাত। ইতোমধ্যে বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার অনুমতি দিয়েছে সরকার।
এয়ারলাইন্স সূত্র জানিয়েছে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের দুজন কেবিন ক্রুকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ফ্লাইটেই তারেক রহমানের লন্ডন থেকে দেশে ফেরার কথা। ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেবে বিমানের বিজি-২০২ ফ্লাইট। তারেক রহমান এই ফ্লাইটে ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা।
ওয়ান-ইলেভেন সরকার ২০০৭ সালে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে। ২০০৮ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্যে যান তিনি। এরপর থেকে সেখানেই আছেন। লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করে আসছেন তিনি। ওয়ান-ইলেভেন সরকার এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক অনেক মামলা করা হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। এরপর বিভিন্ন মামলায় তারেক রহমানের সাজার রায় বাতিল হয় এবং কোনো কোনো মামলায় আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি অব্যাহতি পান। তখন থেকে তার দেশে ফেরার আলোচনা শুরু হয়।
গার্মেন্ট বন্ধ রাখার পরামর্শ বিজিএমইএ’র : এদিকে তারেক রহমানের আগমন উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকার গার্মেন্টস বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিজিএমইএ। এলাকাগুলো হচ্ছে-উত্তরা (পূর্ব-পশ্চিম), উত্তরখান, দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, আব্দুল্লাহপুর, তুরাগ, টঙ্গী, পুবাইল, রূপগঞ্জ, কাঞ্চন ব্রিজ ও আশুলিয়া এলাকার (পূর্বাংশ)। সোমবার বিজিএমইএ-এর ভারপ্রাপ্ত সচিব সাইফুল ইসলামের স্বাক্ষরিত এক নোটিশে এ পরামর্শ দেওয়া হয়।
নোটিশে বলা হয়েছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশ বিমানে বৃহস্পতিবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর ওনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় প্রচুর লোকসমাগম ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য উত্তরা (পূর্ব-পশ্চিম), উত্তরখান, দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, আব্দুল্লাহপুর, তুরাগ, টঙ্গী, পুবাইল, রূপগঞ্জ, কাঞ্চন ব্রিজ ও আশুলিয়া এলাকার (পূর্বাংশ) কারখানাগুলোয় শ্রমিকের যাতায়াত ও আমদানি-রপ্তানির মালমাল পরিবহণে বিঘ্ন ঘটতে পারে। সবদিক বিবেচনা করে এসব এলাকার কারখানার শ্রমিকদের যাতায়াত ও আমদানি-রপ্তানির মালামাল পরিবহণে কারখানা কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করেছে বিজিএমইএ। প্রয়োজনে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে আগে বা পরে যে কোনো একদিন দায়িত্ব পালন করা সাপেক্ষে বৃহস্পতিবার কারখানায় ছুটি রাখা যায় কি না, তা বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি। এছাড়া জরুরি আমদানি-রপ্তানি কাজে ব্যবহৃত কাভার্ডভ্যান চলাচলের বিষয়ে এলাকার সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অন্য পথ ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করেছে বিজিএমইএ।