Image description
বাংলাদেশ-ভারত তিক্ততা বাড়ছেই

বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের তিক্ততা বেড়েই চলেছে। মঙ্গলবার হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মী মিছিল নিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে নয়াদিল্লি ও কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের দিকে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন। কলকাতায়ও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। যদিও পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করে।

এদিকে এ ঘটনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে ঢাকার কঠোর বার্তা দেওয়াসহ পুরো ঘটনায় উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করে। এছাড়া সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানানো ছাড়াও ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কোনো কিছু না ঘটে সে ব্যাপারে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

এর আগে শনিবার রাতে দিল্লিতে ‘অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রসেনা’ নামের এক সংগঠনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করা হয়। ওই বিক্ষোভ থেকে হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকেও হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় নিরাপত্তা শঙ্কায় দিল্লি, আগরতলা ও শিলিগুড়ির হাইকমিশনে ভিসা বা কনস্যুলার সেবা সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেওয়া হয়। এছাড়া এসব ঘটনার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাতে ১০ দিনের ব্যবধানে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে দুদফায় তলব করা হয়।

অপরদিকে ভারত সরকার নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে একদফা তলব করে দেশটির অবস্থানের কথা তুলে ধরে। একই দিন ঢাকায় তাদের ভিসা কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। পরে চট্টগ্রামে ভারতীয় ভিসা আবেদনকেন্দ্রের কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়। এছাড়া ঢাকার অভিযোগকে অস্বীকার করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল দাবি করেন, বাংলাদেশের মিডিয়া প্রোপাগান্ডা করছে।

ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এমন বৈরী অবস্থাকে মোটেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। কয়েকজন বিশ্লেষক যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো মূল্যে এই উগ্রবাদ দমনে ভারত সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে চলমান উত্তেজনা কমাতে ঢাকা ও দিল্লিকে কূটনৈতিক চ্যানেলে সম্মানজনক আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। দুদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে কোনোভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে খারাপের দিকে নেওয়া যাবে না। ভারত সরকারকে দেশটির হিন্দুত্ববাদী উগ্র ধর্মীয়পন্থিদের থামাতে হবে। ঢাকা তো এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল কোনো বিক্ষোভ করতে দেয়নি। যেটুকু হয়েছে তা ছিল শান্তিপূর্ণ এবং ভারতীয় হাইকমিশন থেকে অনেক দূরে।

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক সম্মুখসারির জুলাই যোদ্ধা শরিফ ওসমান বিন হাদিকে হত্যার ঘটনায় অন্যতম পলাতক আসামি শুটার ফয়সাল ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এর প্রতিবাদে আসামিকে ভারত থেকে ফেরত আনাসহ হত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়। সেদিন রাতে চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে একদল মানুষ বিক্ষোভ দেখান। একই রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ময়মনসিংহের ভালুকার একটি কারখানার শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া শুক্রবার ইককিলাব মঞ্চ ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি দিলেও দূতাবাস থেকে অনেক দূরে পুলিশ তাদের আটকে দেয়।

এদিকে এসব ঘটনার প্রতিবাদে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে হিন্দুত্ববাদী উগ্র ধর্মীয় কিছু সংগঠন তাদের উসকানিমূলক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। শনিবার থেকে অব্যাহত রাখা আক্রমণাত্মক বিক্ষোভ কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্রমেই অবনতি ঘটছে।

যা ঘটেছে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে : মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং দুপুরে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে হিন্দুত্ববাদী বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নেন। দুই স্থানেই তারা নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেঙে হাইকমিশনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন।

সকালে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা একাধিক নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেঙে হাইকমিশনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন’ এবং ‘ময়মনসিংহে দিপু চন্দ্র দাস নামের এক হিন্দু যুবককে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে’ এই বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে নিরাপত্তা বাহিনী তা প্রতিহত করে।

হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও বজরং দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে হাইকমিশনের সামনে তিন স্তরের ব্যারিকেড স্থাপন করা হয়। সেখানে পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিলেন। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন ও উপাসনালয় ভাঙচুরের নিন্দা জানিয়ে এই বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিতে দিতে অন্তত দুটি ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন বিক্ষোভকারীরা। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় ব্যারিকেড পুনরায় স্থাপন করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়। এরপর একই দিন দুপুরে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনেও বিক্ষোভকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা চালায়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু দেশটির সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের বরাতে জানায়, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাতে কয়েকশ মানুষ উপহাইকমিশনের সামনে জড়ো হয়েছিল। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। সংবাদমাধ্যমগুলোর শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা গেছে, একদল লোক গেরুয়া রঙের পতাকা হাতে উত্তেজিত হয়ে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করছে।

যা বললেন দুই বিশ্লেষক : এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, উত্তেজনা বাড়িয়ে লাভ নেই। কূটনৈতিক যে নিয়মনীতি এবং শিষ্টাচার আছে সেভাবে দুই দেশকেই আলোচনাকে এগিয়ে নিতে হবে। এছাড়া উভয় দেশকে কূটনৈতিক নীতিনৈতিকতার মাত্রা বজায় রেখে চলা উচিত। এ বিষয়ে উভয় দেশকে সজাগ ও সচেতন থাকা দরকার।

তিনি বলেন, যে কোনো ধরনের উত্তেজনা দূর করতে ঢাকা ও দিল্লিকে উদ্যোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠিত রীতি-নীতি ও পদ্ধতি আছে। সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে বড় ধরনের কোনো উত্তেজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। এমনটা যেন না হয়, সেদিকে জোর দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, সামনে আমাদের জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের এই প্রেক্ষাপটে সব অংশীদার, উন্নয়ন সহযোগী ও কূটনৈতিক অংশীদার সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে একটি কার্যকর নির্বাচন করা যায় সেদিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েরই উচিত সম্পর্ক উন্নয়নের পথ বেছে নেওয়া। দুই দেশের মধ্যেই বর্তমানে টানাপোড়েন আছে, সম্পর্ক বেশ খারাপ অবস্থায়। উচিত হবে এটি আরও খারাপের দিকে না নিয়ে যাওয়া। সম্পর্ক ভালো থাকলে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই উপকৃত হয়। কেউ হয়তো বেশি উপকৃত হবে, কেউ কম। তিনি বলেন, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলেও বলতে হয়, এই বৈরিতা থেকে কেউ কিছু অর্জন করবে না।

মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, বাংলাদেশের সামনে যেহেতু নির্বাচন আছে-সেহেতু সময়টা বেশ স্পর্শকাতর। উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হবে, যদি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়। একই সঙ্গে আগামীতে যে সরকার আসবে সেই সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নির্মাণ করার বিষয়েও ভারতের সচেষ্ট হওয়া উচিত। এখনো যদি ভারতের দিক থেকে বৈরিতা অব্যাহত থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এটি নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। দেখা যাবে এমন সরকার নির্বাচিত হচ্ছে বা জনগণ এই ধরনের রিপ্রেজেন্টেটিভকে বেছে নিচ্ছে, যাদের মধ্যে ভারত বিদ্বেষী মনোভাব কাজ করছে। সে রকম কিছু হলে ভারতের জন্য লাভজনক কিছু হবে না।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি : সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়। নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়াও এসব ঘটনার জন্য ভারত সরকারের কাছে সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানানো হয়।

বিবৃতিতে গত ২০ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রাঙ্গণ ও আবাসস্থলের বাইরে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এবং ২২ ডিসেম্বর শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের ভিসাকেন্দ্রে উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর ভাঙচুরের কথা উল্লেখ করে ভারত সরকারের কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, কূটনৈতিক মিশনগুলোতে এ ধরনের পরিকল্পিত সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শন কেবল কর্মীদের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত করে না, বরং দুই দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং শান্তি ও সহনশীলতার মূল্যবোধকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বাংলাদেশ সরকার ভারতকে এই ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের সব মিশন ও কূটনৈতিক কর্মীদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশা প্রকাশ করে, আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ভারত সরকার কূটনীতিকদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষায় দ্রুত এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষণা প্রতিবেদন : সম্প্রতি ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ‘সোনালি অধ্যায়ের পর : বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সঠিক পথে ফেরানো’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় দুদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব বেড়েছে। ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করতে হলে আওয়ামী লীগনির্ভরতা থেকে সরে আসতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে ভোট পাওয়ার জন্য ভারতবিরোধী মনোভাব ব্যবহার পরিহার করা উচিত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বাচনের পর ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। অন্যদিকে এর বিপরীতে বাংলাদেশের নতুন সরকারকেও ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারত সম্ভবত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না। আগামী নির্বাচনের ফলাফলে যে সরকার বাংলাদেশে আসবে, তাদের নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নতুন করে ঢেলে সাজানো হতে পারে।