বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ কমিয়ে শিল্প কারখানা এবং ক্যাপটিভে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পেট্রোবাংলা। নতুন বছরের শুরু থেকে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করা হবে। বর্তমানে দৈনিক ৮৯ কোটি ঘনফুট থেকে বাড়িয়ে আগামী তিন মাস ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাবে দেশের শিল্প কারখানাগুলো। এর মধ্যে শিল্পে ৫৭ কোটি এবং ক্যাপটিভে ৫৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের সব বিতরণ কোম্পানিকে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে পেট্রোবাংলা।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, শীতকাল ও রমজানসহ সামনের মৌসুম বিবেচনা করে শিল্পে আগামী তিন মাস গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত বছরের মতো এবার বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি। গত বছর বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে তিনটি কার্গো করে এলএনজি আমদানি করতে টাকা দিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। এবার তা-ও দেওয়া হয়নি। তারপরও আমরা শিল্প রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল যুগান্তরকে বলেন, পেট্রোবাংলা যদি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয় তবে ভালো কথা। তবে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি শুধু তিন মাস নয়, সারা বছরই অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই শিল্প বাঁচবে।
দেশে এখন গ্যাসের চাহিদা আছে দৈনিক ৪০০ কোটি ঘনফুটের বেশি। কিন্তু সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে ২৬৫ কোটি ঘনফুটের মতো। কখনো কখনো এই সরবরাহ আরও কমে যায়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ পেট্রোবাংলা শিল্প-ক্যাপটিভে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছিল ৮৯ কোটি ঘনফুট। ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেবে পেট্রোবাংলার বিতরণ কোম্পানিগুলো। এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে। বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম থাকবে। তাই এই সময়ে গ্যাস বেশি পাবে শিল্প কারখানা।
গ্যাসের চরম সংকটের কারণে শিল্প কারখানা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অভিযোগ শিল্প মালিকদের। তারা সংকট নিরসনে অনেক দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। বিশেষ করে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান চলছে না। বসে থাকতে হয় শত শত শ্রমিককে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শীতের কারণে এখন বিদ্যুতের চাহিদা অনেক কম। গরমে যখন ১৫-১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে, সেখানে এখন বিদ্যুৎ লাগছে ১০ থেকে ১১ হাজার মেগাওয়াট। এছাড়া বড় কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পিডিবির জন্য স্বস্তি এনেছে বলে জানা গেছে। পেট্রোবাংলা ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের সরবরাহ কমাতে শুরু করেছে। কিছু দিন আগেও পেট্রোবাংলা থেকে পিডিবি দৈনিক গ্যাস পেত ১০০ কোটি ঘনফুট। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি ঘনফুটে। পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কমলেও গ্যাস কমানোর সিদ্ধান্তে খরচ কমবে না পিডিবির। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, গ্যাসে ৪-৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বেশির ভাগ বিদ্যুৎ গ্রিডে আসবে। এর পরও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পিক আওয়ারে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট ২২ থেকে ২৪ টাকা করে বিদ্যুৎ কিনে সরবরাহ দেয় পিডিবি। যদিও তারা বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে প্রতি ইউনিট বিক্রি করে ৬ টাকা ৬৩ পয়সা। এপ্রিল মাস থেকে গরম ছাড়াও ইরি-বোরো মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা বেশ বাড়বে বলে জানান তারা।
পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, জানুয়ারিতে শীত থাকবে। তাই বিদ্যুতের চাহিদা তেমন বাড়বে না। ফেব্রুয়ারিতে রমজান মাস। তারাবি এবং সাহরির সময় এসির ব্যবহার তেমন না-ও থাকতে পারে। কারণ শীতের আমেজ তখনো থাকবে। মার্চে ঈদের কারণে ১৫ দিনের মতো অফিস-আদালত বন্ধ বা উপস্থিতি কম থাকতে পারে। এ কারণে ওই সময়েও বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকবে। গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হবে কম।
পেট্রোবাংলা আরও জানায়, ২০২৬ সালের এপ্রিলের জন্য অতিরিক্ত গ্যাস আমদানি করা হতে পারে। সেই ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি সরকার। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে নতুন সরকার জ্বালানি খাত নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়তে পারে। বিশেষ করে গ্যাস নিয়ে। পেট্রোবাংলার হিসাবে ২০২৬ সালের জুলাই পর্যন্ত মোটামুটি সরবরাহ ভালো থাকলেও শেষের দিকে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এর অন্যতম কারণ, শেভরনের বিবিয়ানা ক্ষেত্রসহ অন্য ৫টি ক্ষেত্রে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়া। জ্বালানি বিভাগ জানিয়েছে, গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে সারা দেশে ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সব কূপ সফলভাবে খনন করতে পারলে ২০২৬ সালের মধ্যে গ্যাস আসার কথা ৬৪ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট। এর মধ্যে বেশির ভাগ কূপ খননের কাজ শুরু হয়নি অথবা শেষও করতে পারেনি। এর মধ্যে শুধু রশিদপুর-৩ নম্বর কূপ থেকে ৮০ লাখ ঘনফুট এবং হবিগঞ্জ-৫ নম্বর কূপ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে। সামনে আরও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।