বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যে দেশগুলোকে আইনগত সহায়তা চুক্তির (এমএলএটি) প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সেই প্রস্তাবে ‘না’ বলে দিয়েছে প্রভাবশালী তিন রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড। তারা চুক্তির বদলে বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আইনি সহায়তা চুক্তি করতে সমর্থ না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের পাচার অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ হোঁচট খেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত ওয়ার্কিং কমিটি বাংলাদেশ থেকে পাচার অর্থ ফেরত আনার জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতে ও করণীয় নির্ধারণে সময় সময় সভা করছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ওই সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থ পাচার মামলার প্রমাণাদি সংগ্রহ করতে ১৯টি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়। এ ছাড়া অর্থ পাচারের গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ১০টি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া এবং হংকংকে পারস্পারিক আইনি সহায়তা চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর মধ্যে কেবল শেষের তিন রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া এবং হংকং পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। বাকি দেশগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড চুক্তির ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকেও চুক্তির বিষয়ে এখনো সম্মতি পাওয়া যায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার যে দেশগুলো থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, তার মধ্যে যুক্তরাজ্য অন্যতম। দেশটির সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত জুনে যুক্তরাজ্য সফর করেন। তাঁর ওই সফরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল মোমেনকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। সফরে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক না হলেও দেশটির নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে সহায়তা চেয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সফরের পরও আইনি সহায়তা চুক্তিতে যুক্তরাজ্যের সম্মত না হওয়া, পাচার অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রক্রিয়ায় বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিটি যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণার বরাত দিয়ে শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, শুধু দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ৫৩২টি বাড়ি বা সম্পদ আছে, যার মূল্য সাড়ে ৩৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের নেতা ও মন্ত্রীদের একটি বড় অংশ যুক্তরাজ্যে টাকা পাচার করেছেন বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে যুক্তরাজ্যে ৩ শতাধিক সম্পত্তি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্রিটিশ অপরাধ দমন সংস্থা ন্যাশানল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন শ সম্পত্তি জব্দ করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আইনি চুক্তিতে সম্মত না হয়ে কিছু দেশ “বিকল্প পদ্ধতি” অনুসরণের যে পরামর্শ দিয়েছে, তাতে পাচার অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় সমস্যা হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বিলম্ব করা বা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে এটি। বাংলাদেশ হয়তো পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি অথবা ওইসব দেশ পাচারকৃত অর্থ থেকে উপকৃত হচ্ছে-এসব কারণেও আইনি সহায়তা চুক্তি থেকে বিরত থাকতে পারে।
তবে যা-ই হোক, চুক্তি না করা দেশগুলো থেকে পাচার টাকা ফেরত আনতে বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণের সুযোগ রয়েছে।’