দলীয় মনোনয়ন না পেলে হবেন বিদ্রোহী প্রার্থী। এমনই আভাস মিলেছে বরিশালের ৩ জেলার ৭ নির্বাচনি এলাকার বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে। যদিও এ ব্যাপারে এখনই সরাসরি কিছু বলতে চাইছেন না কেউ। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা থাকতে চান দলীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। মনোনয়ন পরিবর্তন হবে-এমন আশাও করছেন তারা। তেমনটা হলে থাকবেন ধানের শীষের কাতারে। নয়তো বিদ্রোহী হয়ে নামবেন দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে। সেক্ষেত্রে এই ৭ আসনের ৬টিতেই জয় পাওয়া মুশকিল হবে বিএনপির। দলীয় ভোট ভাগাভাগির সুযোগ পাবেন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীরা।
বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক এমপি জহিরুদ্দিন স্বপন। তিনি ছাড়াও মনোনয়নের আশায় মাঠে ছিলেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান এবং আইনজীবী নেতা কামরুল ইসলাম সজল। স্বপনকে প্রার্থী ঘোষণার পর অন্য দুজন সরে গেলেও মাঠ ছাড়েননি ইঞ্জিনিয়ার সোবাহান। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে তার অনুসারীরা করছেন সভা-সমাবেশ। আগৈলঝাড়ায় সোবাহানের পক্ষে মানববন্ধন করেছে সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়। গত সপ্তাহে আগৈলঝাড়ার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর থেকে মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছেন সোবাহান। তিনি যদিও সরাসরি দলের বিরুদ্ধে নির্বাচন করার কথা বলছেন না। তবে তার অনুসারীরা বলছেন দলীয় মনোনয়ন না পেলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন। যুগান্তরকে সোবাহান বলেন, ‘শেষমুহূর্ত পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকব। তারপরও যদি মনোনয়ন না পাই, তাহলে এলাকার মানুষ ও ভোটাররা যা বলবে তাই করব।’
বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনে মাঠে থাকা ৩ নেতার মধ্যে মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আইনজীবী নেতা অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন। তবে মাঠ ছাড়েননি মনোনয়নবঞ্চিত দুই নেতা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ও মুলাদী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার খান। মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে সভা-সমাবেশ করছেন দুই নেতার কর্মী-সমর্থকরা। শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার আলোচনাও রয়েছে এখানে। আর এ আলোচনায় এগিয়ে আছেন সাত্তার খান। তিনি নিজেও গুঞ্জনের বিষয়টি উড়িয়ে দেননি। যুগান্তরকে সাত্তার খান বলেন, ‘জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বিএনপি করছি। মামলা-হামলা-নির্যাতন থেকে শুরু করে সব ধরনের অত্যাচার সহ্য করেছি। প্রাথমিক ঘোষণায় দল আমাকে মনোনয়ন না দিলেও আশা ছাড়িনি। তাকিয়ে আছি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ হাইকমান্ডের দিকে। এতকিছুর পরও যদি মনোনয়ন না পাই, তাহলে এলাকার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’ মুলাদী ও বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ‘একসময় সেলিমা রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন সাত্তার। সেলিমার বাড়ি বাবুগঞ্জে। মনোনয়ন না পাওয়ার ক্ষোভে সেলিমা রহমানের লোকজন নীরব সমর্থন দিতে পারেন সাত্তার খানকে। এছাড়া দলীয় মনোনয়ন পাওয়া জয়নাল আবেদিন ও সাত্তার খানের বাড়ি একই উপজেলায় হওয়ায় সেখানেও ভাগ হবে বিএনপির ভোট। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্রোহ সামাল দিতে না পারলে দ্বন্দ্বের ফসল তুলবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।’
প্রাথমিক তালিকায় সুমন মঞ্জুরকে পিরোজপুর-২ (ভাণ্ডারিয়া-কাউখালী-নেসারাবাদ) আসনে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। মনোনয়নের আশায় মাঠে ছিলেন মাহমুদ হোসাইন ভিপি মাহমুদ, ফকরুল ইসলাম ও আলবেরুনী সৈকত। সুমনের বাবা প্রয়াত নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ছিলেন শেখ মুজিব ও খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য। পরে অবশ্য যোগ দেন বিএনপিতে। ’৯০-পরবর্তী একাধিক নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও জামানত হারানোসহ প্রতিবারই শোচনীয়ভাবে হেরে যান নুরুল ইসলাম। মূলত পিতার উত্তরাধিকারেই এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন সুমন। আর এই মনোনয়ন পরিবর্তনের আশায় মাঠে আছেন মাহমুদ হোসাইন ভিপি মাহমুদ ও ফকরুল ইসলাম। নির্বাচনি এলাকার ৩ উপজেলাতেই ভিপি মাহমুদের পক্ষে চলছে মিছিল-সমাবেশ। ফকরুল ইসলামের পক্ষে মানববন্ধন হয়েছে নেসারাবাদে। শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন না পেলে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে নামার কথা শোনা যাচ্ছে ভিপি মাহমুদের। তার অনুসারীরাও বলছেন একই কথা। গত সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের বৈঠকে সুমন মঞ্জুরের অনুপস্থিতিতে আরও চাঙা হয়েছেন তারা। মনোনয়ন পরিবর্তন হবে বলেই সুমন সেখানে ছিলেন না বলছেন অনেকে। ভাণ্ডারিয়া উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ‘ভিপি মাহমুদ ও সুমন দুজনেরই বাড়ি ভাণ্ডারিয়া উপজেলায়। কিংবদন্তি সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ভাতিজা হিসাবে এখানে মাহমুদের রয়েছে শক্তিশালী পারিবারিক অবস্থান। কাউখালী আর নেসারাবাদেও রয়েছে মানিক মিয়া পরিবারের ঐতিহ্যগত অবস্থান। ৩ উপজেলায় যদি ভাগ হয় বিএনপির ভোট, তাহলে জয় পাওয়া মুশকিল হবে ধানের শীষের। যুগান্তরকে ভিপি মাহমুদ বলেন, ‘আবেগের বশবর্তী হয়ে নেতাকর্মীরা অনেক কিছুই বলতে পারেন। আমি অপেক্ষা করছি দলীয় সিদ্ধান্তের। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তাই মাথা পেতে নেব।’
ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনে মনোনয়নের আশায় মাঠে আছেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম আজম সৈকত। এখানে দলের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামালকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও মাঠ ছাড়েননি তিনি। মনোনয়ন পরিবর্তনের আশায় চালাচ্ছেন প্রচার-প্রচারণা। শুক্রবার নিজ উদ্যোগে রাজাপুরে করেছেন বিএনপির উপজেলা কার্যালয়ের উদ্বোধন। কাঁঠালিয়া উপজেলায়ও চলছে তার পক্ষে প্রচারের শোডাউন। ৩০ ডিসেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন জানিয়ে সৈকত বলেন, ‘দলীয় প্রতীকের চিঠি না দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার সুযোগ যেহেতু আছে, তাই মাঠ ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া এই মনোনয়ন যে চূড়ান্ত নয়, তা দলীয়ভাবেই বলা হয়েছে।’ ঝালকাঠি-২ (নলছিটি-ঝালকাঠি) আসনেও শোনা যাচ্ছে বিদ্রোহের পদধ্বনি। এখানে সাবেক এমপি দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইসলাম সুলতানা ইলেন ভূট্টোকে প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়া হলেও এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে জটিলতা। বৃহস্পতিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত মনোনয়নপ্রাপ্তদের বৈঠকে তাকে ডাকা হয়নি। মনোনয়ন পরিবর্তনের গুঞ্জনও চলছে এখানে। তেমন কিছু হলে এই আসনেও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে ধানের শীষের।
পটুয়াখালী-২ (বাউফল) আসনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদারের বিরুদ্ধে মাঠে আছেন মনোনয়নবঞ্চিত দুই নেতা দলের কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক মুনির হোসেন এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদারের সমর্থক অনুসারীরা। দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই তা পরিবর্তনের দাবীতে মাঠে আছেন তারা। শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন না হলে এই আসন থেকেও বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারেন বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতদের কেউ। এছাড়া পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-রাঙ্গাবালী) আসনে এখন পর্যন্ত কাউকে মনোনয়ন দেয়নি বিএনপি। শোনা যাচ্ছে আসনটি ছাড়া হতে পারে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে। সমমনা বিবেচনায় নুরকে আসন ছাড়া হলেও এখানে নির্বাচন করবেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুন। দল মনোনয়ন না দিলেও নির্বাচন করবেন বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন তিনি।
বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘প্রতীক বরাদ্দের পর দলে আর কোনো বিভেদ-বিভাজন থাকবে বলে আমি মনে করি না। বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভে হয়তো অনেকেই এখনো মাঠে আছেন। কিন্তু যখন প্রশ্ন হবে ধানের শীষ, তখন আর কেউ রাগ করে দূরে থাকতে পারবে না। তারপরও যদি কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে দল।’