বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের কার্যক্রম এক মাস ধরে বন্ধ। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। বর্তমানে বোর্ডে প্রায় ৭০ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারীর আর্থিক আবেদন জমা রয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা অবসরে গেছেন, তাদের আবেদন নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে হাজার হাজার শিক্ষক ও কর্মচারী বিপাকে পড়েছেন। অবসরে যাওয়ার পর তাদের আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। পাওনা টাকা না পাওয়ায় এখন অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে তাদের জীবন। এদিকে কারিগরি ত্রুটির কারণে চলতি বছর প্রায় চার মাস অবসর বোর্ডের আবেদনের সার্ভার বন্ধ ছিল। এতে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে গিয়েও যথাসময়ে আবেদন করতে পারেননি। অন্যদিকে অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের নামে ভুয়া ইনডেক্স ও জাল আবেদন দিয়ে বোর্ড থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মাসাৎ করা হয়েছে। সবমিলে অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রাপ্য অর্থ পেতে একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবসর সুবিধার টাকা ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে। তবে তহবিল সংকট, সার্ভার ডাউনসহ নানা জটিলতায় শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরের টাকা পেতে তিন থেকে চার বছর সময় লেগে যাচ্ছে। অনেকের ক্ষেত্রে সময় আরও বেশি লাগে। অবসরে যাওয়ার পর টাকা না পেয়ে মারা গেছেন অনেকে। অনেকে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগে ভুগছেন। এ অবস্থায় বিশেষ ও এককালীন বড় বরাদ্দ না দিলে শিক্ষকদের ভোগান্তি দূর হবে না।
জানা যায়, সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। তাদের অবসর সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে। অবসর সুবিধার জন্য চাকরিকালীন শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ টাকা মাসে কেটে রাখা হয়। এছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ১০০ টাকা (৭০ টাকা অবসরের জন্য) নেওয়া হচ্ছে। বাকি টাকা সরকার ও চাঁদা জমার সুদ থেকে সমন্বয় করে দেওয়া হয়। অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে ৬ শতাংশ হারে টাকা কাটার মাধ্যমে প্রতিমাসে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা আদায় হয়। এফডিআরের লভ্যাংশ হয় প্রতিমাসে ৫ কোটি টাকা। বছরে যা ৯৬০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রতিবছর গড়ে অবসর সুবিধার জন্য আবেদন জমা পড়ে ১৫ হাজার, যা নিষ্পত্তি করতে বছরে দরকার ১৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে ঘাটতি থাকছে ৫৪০ কোটি টাকা। সূত্র আরও জানায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদন নিয়ে কাজ চলছে। এর পর থেকে যারা আবেদন করেছেন, তা ঝুলে আছে। অবসর সুবিধার জন্য চলতি বছর ৩০ জুন পর্যন্ত ৬৪ হাজার ৭৭৫টি আবেদন জমা ছিল। বর্তমানে আবেদনের সংখ্যা ৭০ হাজারের কাছাকাছি। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে ৭ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন। এমতাবস্থায় আদলতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২৩ নভেম্বর থেকে তিন মাস সচিবের রুটিন দায়িত্ব স্থগিত থাকায় হাজার হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর সুবিধা প্রদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১২ নভেম্বর শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সিআর আবরার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার টাকা বরাদ্দের জন্য একটি আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) পাঠিয়েছেন। এতে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘তহবিল ঘাটতির কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীকে অবসর ও কল্যাণ সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রাপ্য সুবিধার জন্য বয়োবৃদ্ধ ও গুরুতর অসুস্থ শিক্ষকরা প্রায়ই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হন। অনেক শিক্ষক প্রাপ্য সুবিধা পাওয়ার আগেই মারা যান। তহবিল সংকটের কারণে শিক্ষকদের প্রাপ্য সুবিধা দেওয়ার ব্যর্থতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক।’ এ বিষয়ে অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যাপক মো. জাফর আহম্মদ যুগান্তরকে বলেন, ‘৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সচিবসহ বোর্ড সদস্যদের অনুপস্থিতির কারণে বোর্ডের নিয়মিত কার্যক্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৪৮টি অবসর আবেদন নিষ্পত্তি করেছি। আর্থিক হিসাবে ৬৭৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তাই শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না। অবসরে যাওয়া অনেকে এখন অসহায় হয়ে ঘুরছেন। কিন্তু আমাদের করার কিছু নেই।’
অবসরে যাওয়া পঞ্চগড় জেলার মাকিনপীর বেংহারী মাদ্রাসার অফিস সহকারী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শেষ বয়সে আমাদের চিকিৎসা দরকার। কিন্তু টাকার অভাবে পারছি না। ধারদেনা করে প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে।’ জানা যায়, অবসর সুবিধা হিসাবে একজন শিক্ষক গড়ে ১২ লাখ আর একজন কর্মচারী ৬ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। কলেজের অধ্যক্ষ সর্বোচ্চ ৩৫ লাখ টাকা পান। এতে অবসর বোর্ডে বছরে প্রয়োজন হয় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু আয় হয় ৯৬০ কোটি। এতে বছরে ঘাটতি থাকে ৫৪০ কোটি টাকা।