আলো ঝলমলে নগরী ঢাকা। এখানকার আকাশছোঁয়া অট্টালিকা আর অভিজাত এলাকাগুলোতে এক শ্রেণির মানুষের বিলাসী জীবনযাপন। অন্যদিকে অন্ধকার বস্তিগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন আরেক শ্রেণির মানুষ; যাদের জীবনে বিলাসিতা নয়, বেঁচে থাকাই বড় বিষয়। এসব মানুষের শ্রমেই শহরের চাকা ঘোরে, অভিজাত শ্রেণির দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সহজ হয়। কিন্তু নাগরিক সুবিধা থেকে তারা একেবারেই বঞ্চিত। ছোট্ট একটি রুমে ৬-৭ জনের বসবাস। ৬-৭টি পরিবারের জন্য একটি টয়লেট ও গোসলখানা। পর্যায়ক্রমে এক চুলায় কয়েক পরিবারকে রান্না করতে হয়। মূলত দারিদ্র্য, নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কাজের অভাব ইত্যাদি কারণে এসব মানুষ গ্রাম থেকে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল-ইউএনএফপিএ বলছে, প্রতিদিন গড়ে ১৫০০ মানুষ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসছেন; যার একটি বড় অংশ আশ্রয় নেন বস্তিতে। বিবিএসএর বস্তিশুমারি অনুযায়ী রাজধানীতে ৩৩৯৪টি বস্তিতে ৪০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করেন। বাস্তব সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। মানুষের এই চাপ ঢাকাকে দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ জনসংখ্যা ও অবকাঠামোগত সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গবেষণা বলছে, ঢাকায় বস্তিবাসীর ৪০ শতাংশ জলবায়ু-বাস্তুচ্যুত। বরিশাল-ভোলা, পটুয়াখালীর পরিবারগুলো নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততায় ভিটেমাটি হারিয়ে ঢাকাকে শেষ আশ্রয় মনে করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান যুগান্তরকে বলেন, ‘জলবায়ু বিপর্যয় এখন শহরমুখী অভিবাসনের অন্যতম কারণ। এছাড়াও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণেও বস্তিতে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তবে রাজনৈতিক কারণে আসা মানুষের সংখ্যা কম। তিনি বলেন, বস্তিজনিত সংকট থামাতে হলে প্রথমেই গ্রাম উন্নয়নে জোর দিতে হবে। কর্মসংস্থান না বাড়ালে ঢাকামুখী যাত্রা থামবে না। স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে বস্তিবাসীরা মৌলিক সেবাটুকু পান না।’
কোথা থেকে আসছে মানুষ : অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকার বস্তিবাসীদের বড় অংশ গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রংপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, শরীয়তপুর, কুমিল্লা ও নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের উপকূল এলাকার। আগে আসা আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন এবং মধ্যস্বত্বভোগী-এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মানুষ ঢাকায় এসে বস্তিতে আশ্রয় নেন। ঘরের ব্যবস্থা করে দেব, কাজের সুযোগ আছে, গার্মেন্টসে চাকরির ব্যবস্থা করে দেব-এমন আশ্বাস পেয়ে অনেকেই ঢাকায় পা রাখেন। এতে বস্তিগুলোর একেকটি সাইড একেকটি অঞ্চলের ‘মিনি গ্রাম’ হিসাবে গড়ে উঠেছে। কোথাও রংপুরের আধিপত্য, কোথাও ভোলা-বরিশাল, কোথাও ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ, আবার কোথাও কুমিল্লা-নোয়াখালী।
বস্তিশুমারির তথ্য বলছে, নদীভাঙনের শিকার মানুষ, তালাকপ্রাপ্ত নারী, গ্রামের কর্মহীন মানুষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষ, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা কিংবা পরিবার ও সমাজ থেকে বিতাড়িত মানুষ বস্তিতে এসে আশ্রয় নেন। এছাড়া অন্যান্য কারণও আছে। জরিপে দেখা যায়, কাজের সন্ধানে ৫০.৯৬ শতাংশ, দারিদ্র্যের কারণে ২৮.৭৬, অন্যান্য কারণে ৯.৪১, নদীভাঙনে ৭.০৪, নিরাপত্তাহীনতা কিংবা বিতাড়িত ২.১৫, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ০.৮৪ এবং তালাকপ্রাপ্ত হয়ে ০.৮২ শতাংশ বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন।
বাসিন্দাদের বেঁচে থাকার গল্প : রূপনগরের চলন্তিকা, শিয়ালবাড়ি, মিরপুর-৭, পল্লবীর পূর্ববস্তি, বনানীর কড়াইল ও বেলতলা-এই ৬টি বস্তির ৫৭ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে জীবনের নির্মম বাস্তবতার কথা। এদের মধ্যে ৩৪ জন পুরুষ (৭ জন নির্মাণ শ্রমিক, ৬ জন রিকশাচালক, ৪ জন হোটেল শ্রমিক, ৩ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ৬ জন পোশাক শ্রমিক, ৫ জন পরিবহণ শ্রমিক ও ৩ জন অনিয়মিত শ্রমিক)। আর ২৩ জন নারী (পোশাক শ্রমিক ১১ জন, গৃহকর্মী ৫ জন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ২ জন, এনজিওকর্মী ২ জন ও গৃহিণী ৩ জন)। তারা জানান, বস্তিতে থাকেন বলে উঁচুতলার মানুষ তাদের বাঁকা চোখে দেখেন। নাগরিক বলে মানতে চান না।
রূপনগরের চলন্তিকা বস্তির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বরিশালে আমার বাবার চালের মিল ছিল। এক রাতে ডাকাতরা মিলে হানা দেয়। সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। এরপর চলন্তিকা বস্তিতে এসে আশ্রয় নেই। গ্রামে জমিজমা কিছুই নেই।’ এই বস্তির নিশাত বেগম বলেন, ‘গ্রামে মেয়েদের কোনো কাজ নেই। তাই ঢাকায় এসে গার্মেন্টে কাজ নিয়েছি। পরে পরিবারের অন্যদের নিয়ে আসি।’
তিনি জানান, গার্মেন্ট শিল্পের কারণে বস্তিতে নারীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। নারী পোশাক শ্রমিকের সিংহভাগই বস্তিতে থাকেন।
শিয়ালবাড়ি বস্তির মোহনা বেগম বলেন, ‘নদী সবই খাইছে। জমি-বাড়ি কিছুই নাই। বাধ্য হয়ে পাঁচ বছর আগে বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকায় এসে এই বস্তিতে উঠি।’ পল্লবীর পূর্ব বস্তির জাহানারা বেগম বলেন, ‘অভাবের কারণে তিন মেয়েকে নিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছি। গ্রামে মেয়েদের কাজ নেই। এখানে কষ্ট আছে, আবার সুযোগও আছে।’
মিরপুর ৭ নম্বর বস্তির খুদে ব্যবসায়ী বিউটি জানান, তার বাবার বাড়ি ময়মনসিংহে। গ্রামে কাজ না থাকায় বাবা এক পরিচিতজনের মাধ্যমে আমাদের (পরিবার) নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর এই বস্তিতেই বসবাস। এখন তার আলাদা সংসার হয়েছে। দুই সন্তান তার। স্বামী পেশায় পোশাক শ্রমিক।
বনানীর বেলতলা বস্তির বাসিন্দা ভোলার রাশিদা বেগম বলেন, ‘নদী ভিটেমাটি খাইছে। গ্রামে ঘরবাড়ি নাই, উপার্জনও নাই। তাই ঢাকায় এসে একটি গার্মেন্টে কাজ করি।’ আরেক নারী রহিমা বেগম জানান, বনানীর দুই বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করেন তিনি। স্বামী রিকশা চালান। দুজনের উপার্জন দিয়ে সংসার চলে যায়। কুমিল্লার আজমল হোসেন জানান, এলাকায় কাজ নেই। তাই ঢাকায় এসে রিকশা চালাচ্ছেন। মাসে হাজার বিশেক টাকা উপার্জন হয়। কড়াইল বস্তির বাসিন্দা আব্দুর রশিদের বাড়ি পটুয়াখালীতে। দেড় যুগ আগে এই বস্তিতে আসেন। তিনি জানান, লবণাক্ততার কারণে এলাকায় ফসল হয় না। নিরুপায় হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। কাজ করেন হোটেলে। আয়ের টাকায় টেনেটুনে সংসার চলে যায়।
ফ্ল্যাটের চেয়েও ভাড়া বেশি : রূপনগরের চলন্তিকা বস্তিতে ৮ বাই ১০ ফুটের একটি টিনশেড রুমের ভাড়া সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে পাশেই ১৫-১৬ হাজার টাকায় তিন রুমের ফ্ল্যাট পাওয়া যায়। কিন্তু ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অনেকেই বস্তিতে থাকেন। বস্তির ঘরভাড়া বেশি হওয়ার কারণ হিসাবে জানা যায়, মধ্যস্বত্বভোগী ও রাজনৈতিক সিন্ডিকেট সরকারি জমি দখল করে ঘর বানিয়ে ভাড়া দেন। তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করে।
জীবনযাত্রা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি : বস্তিতে শুধুই টিকে থাকার লড়াই। জীবন বাঁচানোই এখানে মুখ্য। এখানকার ঘরগুলো স্যাঁতস্যাঁতে, শীতে বাতাস ঢুকে পড়ে, গরমে অসহ্য তাপ, বৃষ্টিতে পানি পড়ে। একেকটি ঘরে ৬-৭ জন করে থাকেন। আর ৬-৭টি পরিবারের জন্য একটি টয়লেট। ড্রেনেজ না থাকায় বৃষ্টি হলেই রাস্তায় হাঁটুপানি জমে। নোংরা পরিবেশে বসবাসের কারণে বস্তির মানুষের অসুখ-বিসুখ যেন নিত্যসঙ্গী। ডায়রিয়া, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, অপুষ্টিসহ নানা রোগশোকে আক্রান্ত হন বস্তির নারী-পুরুষ-শিশুরা। নিউট্রি-ক্যাপের এক গবেষণা বলছে, বস্তির ৫৯ শতাংশ শিশু রক্তস্বল্পতায় ভোগে। ৯১ শতাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত। প্রতি চার পরিবারের একটিতে খাদ্য সংকট আছে।
নিরাপত্তাহীনতা : বনানীর বেলতলা বস্তির এক নারী বলেন, বস্তিবাসীদের মধ্যে একটা আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছে। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসেন। এরপরও নানা কারণে রাত নামলেই ভয় কাজ করে আমাদের মাঝে। আগুন লাগার ভয়। মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারীদের ভয়ে থাকি। বিভিন্ন অপরাধীরা বস্তির ঘরকে নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করে।
আর্থিক বাস্তবতা : অধিকাংশ বস্তিবাসীর পেশা রিকশা চালানো, গার্মেন্টে চাকরি, দিনমজুরি, হোটেলে কাজ, নির্মাণ শ্রমিক, হকারি, ঘরোয়া কাজ ইত্যাদি।