Image description

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে এবার খোদ ভারতেই শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। এতদিন বিষয়টি কূটনৈতিক মহলে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন জাতীয় রাজনীতিতেই ‘হাসিনা হঠাও’ ইস্যু গরম হয়ে উঠেছে।

বিশেষ করে দেশে যখন এনআরসি-এসআইআরের মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত করা হচ্ছে; তখন হাসিনা, কামাল, কাদেরদের আর কতদিন মেহমানদারি করবে দিল্লি-এমন প্রশ্ন তুলছে বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহল। ফাঁসির রায়ের পর সমালোচনা আরো তীব্র হয়েছে।

কূটনৈতিক মহলেও প্রশ্ন উঠছে- মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত একজন নেত্রীকে আশ্রয় দিয়ে মোদি সরকার কেন প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করছে?

ওয়াইসি : ‘স্বৈরাচারকে ভিআইপি মর্যাদা কেন?’

অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি শুরু থেকেই এ বিষয় নিয়ে কঠোর অবস্থানে। সম্প্রতি এক সমাবেশে তিনি বলেন, হিন্দু নির্যাতন নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু ফেলা সরকারই আজ ‘স্বৈরাচারী হাসিনাকে’ ভিআইপি আতিথেয়তা দিচ্ছে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যখন ভিসার জন্য হাহাকার করছে, তখন একজন পলাতক নেত্রীকে বিশেষ খাতির করা হচ্ছে কেন? ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণের ম্যান্ডেটকে সম্মান জানানো, কোনো পলাতক নেতাকে নয়।

তার এ বক্তব্য ভারতের সংখ্যালঘু সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীদের মধ্যে প্রবল সাড়া ফেলেছে। তাদের মতে, একজন দণ্ডিত নেত্রীকে আশ্রয় দেওয়া ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির পরিপন্থী।

পশ্চিমবঙ্গে উদ্বেগ—‘হাসিনা এখন লায়াবিলিটি’

বাংলাদেশ ইস্যুতে বরাবরই সরব পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রকাশ্যে না বললেও পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির একাংশ, স্থানীয় নেতা এবং সীমান্ত রাজনীতিতে সক্রিয় মহল-সবাই মনে করছেন, শেখ হাসিনা এখন ভারতের জন্য ‘লায়াবিলিটি’।

মমতার নরম-কঠোর বার্তা

এতদিন নীরব থাকলেও সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছেনÑআমরা সবসময় মানবিক কিন্তু প্রতিবেশী দেশের পরিস্থিতি ও মানুষের আবেগও বিবেচনা করতে হবে। একজনের কারণে দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। আইনকে আইনের পথে চলতে দেওয়াই উচিত। বিশ্লেষকদের মতে, মমতার এ বক্তব্য কার্যত হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবিরই পরোক্ষ সমর্থন।

কংগ্রেস, তৃণমূল, বাম—সবাই এক স্বরে

বিজেপি-এআইএমআইএমের সমালোচনার পর এবার কলকাতার কংগ্রেস, তৃণমূল ও বাম দল, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রসমাজ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দাবিতে সরব হয়েছে। তাদের স্পষ্ট কথাÑবাংলাদেশের বিচারের সামনে দাঁড়াতেই হবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে।

প্রদেশ কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী বরাবরই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কড়া পর্যবেক্ষক। হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারত কোনোদিনই স্বৈরাচারীদের সেফ হ্যাভেন হতে পারে না। বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা জনরোষের বহিঃপ্রকাশ।

বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সাবেক আমলা জহর সরকার বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ যা চাইছে সেটা আমাদের দেখতে হবে। একতরফাভাবে একটি মত আমরা চাপিয়ে দিতে পারি না। যদি সে দেশে

ভারতবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসে, তখন কী হবে?

এদিকে সিপিআইএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গণতন্ত্র হত্যাকারী কোনো শাসকের জায়গা ভারতে হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর যে গুলি চলেছে, তার দায় হাসিনাকে নিতেই হবে। তাকে জামাই আদর করে রেখে ভারত সরকার ভুল বার্তা দিচ্ছে। অবিলম্বে তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হোক, যাতে তিনি তার কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে পারেন।

রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি কলকাতার সুশীল সমাজ এবং ছাত্ররাও হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবিতে রাজপথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মানবাধিকার ইস্যুতে বরাবরই সরব বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক সৌমিত্র দস্তিদার বলেন, ইতিহাস সাক্ষী- যখনই কোনো শাসক জনগণের কণ্ঠরোধ করেছে, তার পতন হয়েছে। বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষের রক্তের দাগ যার হাতে, তাকে মানবিকতার দোহাই দিয়ে আশ্রয় দেওয়া মানে সে অপরাধকে সমর্থন করা। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোই একমাত্র ন্যায়বিচার।

অন্যদিকে ছাত্রনেতা অত্রি ভট্টাচার্য কলকাতার ছাত্রসমাজের মনোভাব তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের জেন-জি যে লড়াই করেছে, আমরা তার সঙ্গে আছি। খুনি হাসিনাকে রক্ষা করার কোনো নৈতিক অধিকার ভারতের নেই। তাকে ফেরত পাঠাতেই হবে।

রাজনৈতিক ও জনমতের এ চাপ মোদি সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অভ্যন্তরেই যখন ‘হাসিনা হঠাও’ দাবি জোরালো হচ্ছে, তখন তাকে দীর্ঘদিন ধরে আগলে রাখা দিল্লির জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি কলেজ স্ট্রিট প্রাঙ্গণেও হাসিনাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার দাবি তুলে পোস্টার লাগানো হয়।