Image description
স্থায়ী কমিটির বৈঠক

রাজকুমার নন্দী 8 রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের অনেক প্রস্তাবকেই ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে করছে বিএনপি। দলটির অভিমত, অপ্রয়োজনীয় এসব সংস্কার প্রস্তাব জটিলতা আরও বাড়াবে। তাই সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে শিগগির সরকারের সঙ্গে বৈঠকের আশা করছে বিএনপি। একই সঙ্গে এতদিন পরে এসে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, সেটাকেও এখন ‘সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক’ বলে মনে করছে দলটি। গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জানা গেছে, বৈঠকে বেশ কয়েকটি এজেন্ডা থাকলেও মূলত দুটি এজেন্ডার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি হচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র। অন্যটি হচ্ছে, সরকারের তরফ থেকে সংস্কারের উদ্যোগ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ডাকে গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। সেদিন বিএনপির তরফ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে যে বিষয়গুলো জানানো হয়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সেটা তিনি তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টার সর্বদলীয় ওই বৈঠকে ঘোষণাপত্র নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি। সেখানে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যে কোনো গণঅভ্যুত্থান-গণআন্দোলনের রাজনৈতিক দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতৈক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে এর আইনি ভিত্তি কী হবে, সে ব্যাপারেও যথেষ্ট আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এত সময় পরে এসে কেন এই উদ্যোগ, সর্বদলীয় বৈঠকে সেটাও তিনি জানতে চান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে একটি ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র ভিত্তিতে। এখন সাড়ে পাঁচ মাস পরে তারা যে ঘোষণাপত্র দিতে চান, সেটি সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক। এখন এটার আর প্রয়োজনীয়তা আছে বলে তারা মনে করেন না। যদি তারা (বৈষম্যবিরোধী ছা্ত্র আন্দোলন) সেই সময় এ ধরনের কোনো ডিক্লারেশন দিতো, সেটি নিয়ে তখন হয়তো একটা রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি হতে পারতো। কারণ, সবাই তখন ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন চেয়েছিল। বৈঠকে এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা আরও বলেন, ফ্যাসিবাদের পতন হলেও দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করতে তাদের দোসরদের নানামুখী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। এর বাইরেও দেশে বিতর্ক সৃষ্টির নানা চেষ্টা আছে। এর আগে সংবিধান বাতিল করার দাবি এসেছে। কেউ কেউ বিদ্যমান সংবিধানকে ছুড়ে ফেলার কথা বলেছে। এর পরপরই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। রাজনৈতিক মতৈক্য না হলে এটিও এক ধরনের বিতর্ক-বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে সরকারের গঠন করা সংস্কার কমিশনগুলোর কয়েকটি এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এসব প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে চলে এসেছে। জানা গেছে, এসব প্রতিবেদন নিয়েও বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেন, সময়ের চাহিদা ও বাস্তবতাকে মাথায় রেখে বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারে জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। এর অংশ হিসেবে ২০২২ সালেই তারা ৩১ দফা রূপরেখা দিয়েছে। এই ৩১ দফাই হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারের সবচেয়ে বড় দলিল। এমনকি এই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার পরে কমিশনকে সহযোগিতা করতে তারা নিজেরাও দলীয়ভাবে ছয়টি সংস্কার কমিটি গঠন করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কী ধরনের সংস্কার আনা যেতে পারে, সেসব সুপারিশ তারা এরই মধ্যে কমিশনের কাছে তুলেও দিয়েছে। বিএনপি আশা করছে, বিভিন্ন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার শিগগিরই একটি রাজনৈতিক সংলাপ আহ্বান করবে, যেখানে বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে এবং রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহীত হবে। এদিকে দেশের পুরোনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার বিষয়ে সুপারিশের কথা ভাবছে সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ব্যবস্থাপনা প্রদেশের হাতে দেওয়ার পক্ষে এ কমিশন। এই চার প্রদেশ হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিএনপি নেতাদের অভিমত, এটা অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাব। বাংলাদেশে এটার কোনো বাস্তবতা নেই, বরং এটা নানান ধরনের জটিলতা বাড়াবে। এতে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। অঞ্চলভিত্তিক নানা জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান হতে পারে, যারা সেখানে নিজেদের টেরিটরি ঘোষণা করতে পারে, যেগুলোর ওপরে একটা পর্যায়ে হয়তো সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের উদাহরণ আছে। সুতরাং এটা বিতর্ক আরও বাড়াবে এবং রাষ্ট্রের যে সার্বভৌম অস্তিত্ব, সেটাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। তাই এটার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে বিএনপি মনে করে না। এসব ছাড়াও বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিরণগঞ্জ সীমান্তে সংঘর্ষ, বিএসএফের গুলি ও বাংলাদেশিকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা, দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সম্প্রতি মাধ্যমিক পর্যায়ের একটি পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত গ্রাফিতি বাদ দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্ক ও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর চীন এবং অরুণাচলের সিয়াংয় নদীর ওপর ভারতের বাঁধ নির্মাণের ‘উচ্চাভিলাসী’ প্রকল্প নিয়েও আলোচনা করেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তাদের অভিমত, বাংলাদেশের ওপর এর ব্যাপক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে।