Image description

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতির স্মরণে গণভবনকে জাদুঘর রূপান্তরের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মন্থর গতি বিরাজ করছে। গত চার মাসে গণপূর্ত মন্ত্রণলায় থেকে গণভবনের বরাদ্দপত্র বুঝে পেয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘরের বিশেষ সেল হবে, না স্বতন্ত্র জাদুঘর হবে-সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ অবস্থায় হাজারো শহিদ, পঙ্গু ও ক্ষতিগ্রস্তদের স্মৃতি ধরে রাখতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগকে কচ্ছপের পিঠে স্বপ্নের যাত্রা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের ঘোষণার চার মাস অতিবাহিত হলেও সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। সরকারের উপদেষ্টাদের কিছু বক্তব্য-বিবৃতি দৃষ্টিগোচর হয়েছে; তবে ঢিমেতালে চলছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কাজ। চার মাসের বেশি সময়েও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কাজও শেষ হয়নি। এরপর জাদুঘরের নকশা তৈরি, প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া রয়েছে। এসবের পরই বাস্তবায়ন কাজে হাত দিতে হবে। বর্তমান সরকারের মেয়াদে কাজটি শুরু না হলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর তৈরির স্বপ্ন অধরাই থাকতে পারে।

প্রসঙ্গত, গত ৫ সেপ্টেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বৈঠক শেষে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেছিলেন, আপানারা জানেন, একটি গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সাউথ কোরিয়ায় মেইড ইন মেমোরিয়াল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পৃথিবীতে আরও বিভিন্ন জায়গায় এমন হয়েছে। সেখান থেকে তাদের অভিজ্ঞতা নেওয়া হবে। এছাড়া একটি সুন্দর জাদুঘরে কীভাবে ফ্যাসিস্টদের মেয়াদে অত্যাচারের স্মৃতি এবং আমাদের শহিদদের স্মৃতি সংরক্ষণ করা যায়, এ ব্যাপারে খুব দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

২ নভেম্বর এক ব্রিফিংয়ে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, গণভবনে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ বিষয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। সেখানে তিনি কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে যে নিপীড়নের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে, সেগুলোও সংরক্ষণ করা হবে। এর পাশাপাশি এ জাদুঘরে ছাত্র-জনতার বিজয়ের স্মৃতিচিহ্নও সংরক্ষণ করা হবে। জাদুঘরে ‘আয়নাঘর’-এর একটি রেপ্লিকা তৈরির কথাও ভাবা হচ্ছে। স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের পাশাপাশি গবেষণার ক্ষেত্র হিসাবেও এই জাদুঘর গড়ে তোলা হবে।

গণপূর্ত অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা জানান, গণভবনের জায়গার পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬৮ একর, অর্থাৎ ৫৩ বিঘা জমি। সেখানে দুই তলাবিশিষ্ট একটি ভবন এবং কর্মচারীদের জন্য এক তলার কয়েকটি পাকা এবং সেমিপাকা স্ট্রাকচার আছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সময় থেকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ওই ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর)। ১ জানুয়ারি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গণভবনের বরাদ্দ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দিয়েছে। এরপর পিজিআর চলে যায়। ১২ জানুয়ারি থেকে গণভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ আনসার বাহিনীর সদস্যরা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ৭০ জন আনসার গণভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন। তবে বর্তমানে সেখানে ২১ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।

গণভবনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী খান যুগান্তরকে বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তারা গণভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত জাতীয় জাদুঘরের একজন প্রতিনিধি সেখানে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা সেখানে সন্ধ্যায় গিয়ে কয়েকদিন আলো জ্বালিয়েছেন। এখন আর সন্ধ্যায় লাইট জ্বালাতে ওইসব কর্মীদের প্রয়োজন হচ্ছে না। আনসার সদস্যরাই লাইটগুলো জ্বালিয়ে নিচ্ছেন। মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে গণপূর্তের কর্মীরা তদারকি করছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, একসময় নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা গণভবনে এখন ভূতুড়ে পরিবেশ। সন্ধ্যা নামলে ভবনটির পাশের সড়ক দিয়ে চলাচলের সময় অজানা আতঙ্ক তাড়া করে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বন্দুক তাক করে থাকার সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না। শুধু তাই নয়, গণভবন থেকে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রমুখী সড়কে সন্ধ্যার পর কোনো মানুষ বা নিরাপত্তা বাহিনীর কাউকে দেখা যায় না। দুর্ঘটনা এড়াতে মানুষ ওই সড়ক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।

গণভবন ক্যাম্পাসটি ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীতে এক টুকরো সবুজ। ভবনটি নিছক একটি দালান হলেও বাস্তবে তা দালানের চেয়েও বেশি কিছু। অর্ধশত বিঘা জায়গাজুড়ে অবস্থিত গণভবন চত্বরে আছে-লন, বাগান, খেত, পুকুর এবং নানান ধরনের ফলের বাগান। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ৫ আগস্ট গণভবন দখলের দিন এর চারদিকের নিরাপত্তা প্রাচীর ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দেয়। চারপাশের গর্তগুলো দিয়ে গণভবনের ভেতরে কোথায় কী আছে এবং তা পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার যুগান্তরকে বলেন, ‘গণভবন’ গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জানুয়ারি থেকে গণভবনের তদারকি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় করছে। তবে গণভবনে কোনো স্থাপনা করতে হলে এর নকশা, প্রকল্প এবং ওই প্রকল্পের বাস্তবায়ন গণপূর্ত অধিদপ্তর করবে। কিন্তু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব গণপূর্ত বিভাগ পায়নি।

এ বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুবিভাগের উপসচিব মো. সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ১ জানুয়ারি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে গণভবনের বরাদ্দপত্র সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পেয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ের নির্দেশনার আলোকে ধাপে ধাপে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর তৈরির কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগের উপকিপার নাছির উদ্দিন আহমেদ খান যুগান্তরকে বলেন, গণভবনকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন আলোচনা চলছে যে, জাতীয় জাদুঘরের আওতায় একটি বিশেষ শাখা হবে, নাকি স্বতন্ত্রভাবে গণভবন জুলাই স্মৃতি জাদুঘর হবে। তবে বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি।

সময়ের আঁকাবাঁকা পথে গণভবন : স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের বাসভবন হিসাবে সংসদ ভবনের পাশে গড়ে তোলা হয়েছিল গণভবন। পরে একপর্যায়ে এটি হয়েছিল রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা। ১৯৯৬ সালে আবার প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির মর্যাদায় ফিরেছিল ভবনটি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়িটির নাম ও মর্যাদারও বদল ঘটেছে। এ রূপবদলের ধারায় নির্মাণের অর্ধশত বছর পর ভবনটি জাদুঘর হতে চলেছে।

তথ্যানুসন্ধান জানা যায়, ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও সচিবালয় হিসাবে শেরেবাংলা নগরে গণভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। কাজ শুরুর পর ত্বরিত গতিতে এক বছরের মধ্যে নির্মাণ শেষ হয়। বঙ্গবন্ধু সেখানে সান্ধ্যকালীন অফিস করতেন। সেখানে বিদেশি অতিথি, কূটনৈতিকসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ দিতেন। তার মৃত্যুর পর গণভবনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর সার্ক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ গণভবন সংস্কারের উদ্যোগ নেন। সংস্কার শেষে ১৯৮৬ সালে ভবনের নাম পরিবর্তন করে ‘রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন করতোয়া’ করা হয়। ১৯৮৮ সালে আরেক দফা সংস্কার করে এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান ও কাজী জাফর আহমেদ সেখানে অফিস করতেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদ দুই ঈদের সময় সেখানে জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের পর অতিথিশালা হিসাবেই থাকে গণভবন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার স্মৃতিবিজড়িত গণভবনেই ওঠার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময়ে বাড়িটি নিজের নামে করে নেওয়ারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এক টাকার বিনিময়ে গণভবনের ইজারা বা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল তাকে; যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ২০০১ সালে লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে গণভবনের ওই বরাদ্দ বাতিল করে। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গণভবনের নাম পরিবর্তন করে ‘প্রাইম মিনিস্টারস অফিস’ করেছিলেন। তিনি সেখানে অফিস না করলেও দুইবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদ গণভবনে উঠবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে তিনি সেখানে ওঠেননি। ২০০৯ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে গণভবনে উঠেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেসময় গণভবনের ব্যাপক সংস্কার করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেও গণভবনকে নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা করেন হাসিনা। ২০০৯ সালে তার সরকার বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নিরাপত্তায় ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করে। সেই আইনে ছিল বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা এবং তাদের সন্তানদের নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা করবে সরকার। এর মাধ্যমে সরকারপ্রধানের পাশাপাশি বাড়িটিতে থাকার আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় প্রয়াস চালিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

সবশেষ গত বছরের জুলাই-আগস্টে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারে গণভবন ছেড়ে ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর বাড়ির মূল ফটক আক্ষরিক অর্থেই খুলে যায়। সেদিন বিকালে উল্লসিত জনতার মিছিল ঢুকে পড়ে গণভবনে। ওই ভবনের শোবার ঘর থেকে শুরু করে পুরো ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের অবাধ বিচরণভূমি ও উৎসবের কেন্দ্রে। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০৯’ বাতিল করা হয়। ফলে গণভবনে থাকার আইনি অধিকার হারায় শেখ হাসিনার পরিবার।