Image description

শফিকুল ইসলাম 8 পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামপন্থি দলগুলোর কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে বেশ জোরালো হয়েছে। বিভিন্ন ইসলামী দলের অভ্যন্তরীণ ও পারস্পরিক যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন একই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কীভাবে করা যায়, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। যাতে এবারের সংসদ নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর পালে লাগে নতুন হাওয়া। এজন্য অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নয়া জোট বা ভিন্ন কোনো প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্দেশ্যে প্রায় সব ইসলামী দল একমত পোষণ করলেও চূড়ান্ত কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নেই। তবে আভাস পাওয়া গেছে, নতুন জোট গঠনের প্রক্রিয়া অনেকটা এগিয়েছে এবং জোট গঠনের বিষয়টি অপেক্ষাধীন। শিগগির এ বিষয়ে রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে, যার নেপথ্যে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এরই মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক মতবিনিময় করেছেন। অবশ্য ইসলামী দলগুলোর ঐক্য নিয়ে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর খেলাফত মজলিসের দ্বাদশ সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন বিভিন্ন দলের নেতারা। জামায়াত আমির ও চরমোনাই পীরের বৈঠক নিয়ে কৌতূহল: জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকলেও নতুন পরিস্থিতিতে দূরত্ব ঘোচার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দুপুরে বরিশালে চরমোনাই পীরের দরবারে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। পরে তিনি চরমোনাই পীরের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। এ নিয়ে রাজনীতিসহ জনমনে ব্যাপক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, ইসলামী দলগুলোর ঐক্য তাহলে চূড়ান্ত হওয়ার পথে। আবার কেউ কেউ বলছেন, এত দ্রুত সম্ভব নয়। বিভাগীয় কর্মী সম্মেলনে যোগ দিতে মঙ্গলবার সকালে বরিশালে যান জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। সম্মেলনে যোগদানের আগে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তিনি বরিশাল সদরে চরমোনাই পীরের দরবারে দলটির আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা রাজনৈতিক নানা বিষয়ে কথা বলেন। পরে দুদলের নেতা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। ইসলামী দলগুলোর ঐক্য বা জোট হচ্ছে কি না, প্রশ্নের জবাবে দুদলের আমির ঐক্যের জন্য জনসাধারণের কাছে দোয়া চান। তারা বলেন, ইসলামী দলগুলো ভোটকেন্দ্রে একটি বাক্স পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা মূলত ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য দেখতে চাই। আমাদের মিলনমেলা আল্লাহর জন্য। এই মিলন রাজনীতির মাঠেও থাকবে। আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। জনগণের প্রত্যাশা, নির্বাচনের সব কেন্দ্রে ইসলামী দলগুলোর যেন একটি বাক্স থাকে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চরমোনাই পীর বলেন, নির্বাচনের সময় ইসলামের পক্ষে একটি বাক্স কেন্দ্রে পাঠানোর প্রচেষ্টা আগেও ছিল, এখনো চলছে। বিভিন্ন কৌশলে গত ৫৩ বছর ইসলামী দলগুলোকে দূরে রাখা হয়েছে। ৫ আগস্ট নতুন স্বাধীনতার মাধ্যমে ইসলামী পক্ষের জন্য একটি ভালো ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তবে আমরা যদি সময়োপযোগী বিচার না করি, তা আমাদের জন্য অকল্যাণকর হতে পারে। দুই দলের নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে দুই দল এতদিন পরস্পরবিরোধী থাকলেও এখন অনেক বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করছে। এটা দুই দলের ঐক্যের সূচনা পর্ব বলা যেতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমবারের মতো জামায়াতের কোনো আমির চরমোনাই পীরের দরবারে গিয়ে দলীয় প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বনিবনা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ—এমনটা বিবেচনায় নিয়ে জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা অন্যান্য ইসলামী দলের সঙ্গে একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়তে চাইছেন। এ লক্ষ্যে দলটি যোগাযোগ বাড়িয়েছে। তবে নির্বাচনী ঐক্য গড়ার বিষয়টি এখনো দৃশ্যমান নয়। চূড়ান্ত রূপ নিতে আরও সময় লাগবে। যদিও চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বরাবরই বলেছে যে, জামায়াতের সঙ্গে তাদের আদর্শগত কিছু মতানৈক্য রয়েছে। যে কারণে ঐক্য গড়তে বিলম্ব হচ্ছে। কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ইসলামী দলগুলোর ঐক্য গড়তে কোনো বাধা হবে না। কেননা জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী ঐক্য শক্তিশালী হবে না বলে অধিকাংশের মত। এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘দুদলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক কেবলই সৌজন্য সাক্ষাৎ। আমরা দ্রুত ঐক্য চাই। বিষয়টি এখনো আলোচনার মধ্যেই রয়েছে।’ দুই দলের শীর্ষ নেতার সাক্ষাৎ ঐক্যের সূচনা কি না জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ কালবেলাকে বলেন, কেউ তো বলেনি যে, ওই বৈঠক ঐক্যের সূচনা। আমরা সব দেশপ্রেমিক দল ও ইসলামী শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে চব্বিশের আন্দোলনের চেতনা সমুন্নত থাকবে। আমরা বহুকাল এদেশে রাজনীতি করছি। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই যোগাযোগ রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় চরমোনাই পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। এটি নতুন নয়। ইসলামী দলের নেতাদের অভিমত: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যার যার অবস্থান থেকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করছে বিভিন্ন ইসলামী দল। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যস্ত দলগুলোর নেতাকর্মীরা। নতুন প্রেক্ষাপটে একটি ‘নির্বাচনী ঐক্য’ গড়তে তারা পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছেন। বিশেষ করে ইসলামী কয়েকটি দলের সঙ্গে ‘নির্বাচনী ঐক্য’ গড়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়তে চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ লক্ষ্যে দলটি এরই মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে মতবিনিময় করেছে। যার মধ্যে পাঁচটি ইসলামী দল এবং আলেম সমাজ রয়েছে। এদিকে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের এক সম্মেলনে অংশ নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির (চরমোনাই পীর) মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, আমরা অনেকটা ঐক্যের কাছাকাছি চলে এসেছি। শিগগিরই তার বাস্তবায়ন দেখা যাবে ইনশাআল্লাহ। এ সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, মানবাধিকার সুরক্ষা, সুশাসন ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ খেলাফত। এজন্য আমাদের সবাইকে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, আমরা অনেক ইসলামী সংগঠন অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে চলেছি। আমরা সব ইসলামী সংগঠন আগামীর বাংলাদেশে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে চাই। জাতীয় নেতারা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে তা পালনে প্রস্তুত থাকতে হবে। এর আগে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সমমনা দলগুলোর প্রথম একটি বৈঠক হলেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। গত বছরের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সিরাতুনন্নবী (সা.) মাহফিল। সেখানে বিভিন্ন আকিদার বক্তারা দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠায় ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ইসলাম ও দেশের স্বার্থে সব বিভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রায় সাড়ে ১৫ বছর পর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এই মুহূর্তে দলটি সারা দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। দলটির শীর্ষ নেতারা সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পৃথক বৈঠকে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন। তারই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার ২৩ দিনের মাথায় দল নিষিদ্ধের আদেশও প্রত্যাহার হয়। এখন বিভিন্ন ইসলামী দলের সমন্বয়ে একটি ‘নতুন প্ল্যাটফর্ম’ গড়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায় জামায়াত। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরে ‘সমমনা ইসলামী দলসমূহ’ নামে ছয়টি দলের একটি জোট আছে। এই জোটের শরিক দলগুলো হচ্ছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক), মুসলিম লীগ (আবুল খায়ের), খেলাফত মজলিস (আহমদ আবদুল কাদের), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। অবশ্য ইসলামী ঐক্য আন্দোলন নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। আর খেলাফত আন্দোলন জোটের অবস্থানের বাইরে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের অধীন ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। সমমনা ইসলামী দলের একজন নেতা জানান, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন ছাড়া বর্তমানে তাদের জোটে চারটি দল সক্রিয় আছে। তারা জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। বিশ্লেষক মত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, চরমোনাই পীরের সঙ্গে জামায়াতের আমিরের বৈঠক নিঃসন্দেহে নতুন কিছু করার একটি বিষয়কে ইঙ্গিত দেয়। দেশে বিভিন্ন দলের কারণে ইসলামী চিন্তাচেতনা নিয়ে যে বিরোধ, সেটির জন্য বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয়। সেই সমস্যাগুলো পরিহার করার জন্য ইসলামী দলগুলো যদি গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে বা গণতন্ত্রকে উজ্জীবিত রাখার ধারা তৈরি করতে পারে, সেটি তো ভালো কিছু। ঐক্যবদ্ধ হলে ইসলামী দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ভুল বোঝাবুঝি ও অবিশ্বাস দূর হয়। রাজনীতিতে আস্থার জায়গাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চরমোনাই পীরের সঙ্গে জামায়াতের আমিরের সাক্ষাৎ তো আস্থারই ছবি। ইসলামী দলগুলো আগামীতে বিরোধী দল হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করবে জনগণের ভোট এবং দলগুলোর ঐক্য ও প্রার্থী বাছাইয়ের ওপর।