Image description

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন সমঝোতা নিয়ে এখনো স্পষ্ট অবস্থান জানায়নি জামায়াতে ইসলামী। এ ক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছে দলটি। ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা সাতটি দলকে নিয়ে পাঁচ দফা দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর একধরনের চাপ বজায় রেখে নির্বাচনী কৌশল সাজাচ্ছে। পাশাপাশি ‘এক আসনে এক প্রার্থী’—এই নীতিকে ভিত্তি করে দলগুলো আসনভিত্তিক জরিপ চালাচ্ছে। জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। সম্ভাব্য এই নির্বাচনী সমঝোতায় আরও কয়েকটি দলকে পাশে পেতে চেষ্টা চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।

আপাতত জোট না করে ‘নির্বাচনী সমঝোতার’ কথা বলে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে জামায়াতসহ আট দল। এটা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ চূড়ান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন দলগুলোর নেতারা। তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও এই সমঝোতা কৌশলের কাজ চলমান থাকবে। দলের বাইরে কোথাও কোথাও অন্য দলের প্রভাবশালী বা মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থীর সঙ্গেও ঘোষিত বা অঘোষিত সমঝোতা হতে পারে।

কে কোন আসন পাবে, কীভাবে সমঝোতা হবে, এসব নিয়ে আলোচনা চলছে। তফসিলের আগেই সমঝোতা চূড়ান্ত করার লক্ষ্য আছে।
হামিদুর রহমান আযাদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী

জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমমনা আট দলের সঙ্গে আরও দল যোগ হতে পারে। আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে চমক দেখা যেতে পারে।’

গত শনিবার জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা কনভেনশনাল (প্রচলিত) কোনো জোট করব না। কিন্তু অনেকগুলো দল ও শক্তির সঙ্গে আমাদের নির্বাচনী সমঝোতা হবে।’

তবে আর কোন কোন দলের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা বা আলাপ চলছে, সেটা এখন প্রকাশ করতে চাইছে না জামায়াতে ইসলামী। তবে সমমনা কয়েকটি দলের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনী আসন সমঝোতায় জামায়াতসহ আট দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও গণ অধিকার পরিষদকেও পাশে পেতে চায়। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা বা যোগাযোগ হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট অপর রাজনৈতিক একটি সূত্র জানায়, এবি পার্টি, এনসিপি, গণ অধিকার ও আপ বাংলাদেশ মিলে নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার সম্ভাব্যতা নিয়ে একটা রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। এই প্রচেষ্টায় যুক্ত ব্যক্তিদের মতে, এ রকম কোনো নির্বাচনী জোট হলে তারা জামায়াতের ভোটে ভাগ বসাবে। সে কারণে জামায়াত এই দলগুলোকে নির্বাচনী সমঝোতায় পাশে পেতে চায়।

যদিও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এনসিপি কোনো ধরনের ক্ষমতার জন্য, আসনের জন্য কারও সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা করবে না।

এদিকে জামায়াতসহ সমমনা আট দল–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কেবল রাজনৈতিক সমঝোতা নয়—কোন আসনে কোন দলের প্রার্থীর জনপ্রিয়তা বেশি, সেটি মাঠপর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে মনোনয়ন বা আসন ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে প্রতিটি দলকে অভ্যন্তরীণ জরিপ চালিয়ে তথ্য লিয়াজোঁ কমিটিতে জমা দিতে বলা হয়েছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী প্রথম আলোকে বলেন, জনপ্রিয়তা ও বিজয়ের সম্ভাবনা যাচাইয়ে ৩০০ আসনেই জরিপ চলছে। নভেম্বরেই কাজ শেষ হয়ে যেতে পারে। এরপর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে।

আগামী নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামী। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একসময়কার ওই দুই মিত্র দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াত ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে এগিয়ে যায়। দলগুলো হলো চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি।

জামায়াতে ইসলামীর হয়ে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে লিয়াজোঁ করছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা একসঙ্গে নির্বাচন করব বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

তবে কবে নাগাদ সমঝোতার বিষয়টি স্পষ্ট হবে, সেটির সময়সীমা বলেননি তিনি। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, কে কোন আসন পাবে, কীভাবে সমঝোতা হবে—এসব নিয়ে আলোচনা চলছে। একটু সময় নেওয়া হচ্ছে। তবে নির্বাচনের তফসিলের আগেই সমঝোতা চূড়ান্ত করার লক্ষ্য আছে।

দুই কারণে অপেক্ষা

জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর নেতারা জানান, আট দলের মধ্যে একটা ভালো বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। তবে আসন সমঝোতার বিষয়ে চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে দুটি কারণে সময় নেওয়া হচ্ছে। এক. আট দলের বাইরে যে দু-তিনটি দলের সঙ্গে অনুষ্ঠানিক আলোচনা বা যোগাযোগ চলছে; শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয় কি না, হলে কত আসন ছাড়তে হতে পারে, সেটা বিবেচনার বিষয় রয়েছে। দুই. সমঝোতা ঘোষণার পর যাতে দলগুলোর মধ্যে অন্য কারও প্ররোচনায় সংকট সৃষ্টি না হয়, সেটাও নিশ্চিত করা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমমনা একটি দলের শীর্ষ নেতা প্রথম আলোকে বলেন, আগামী নির্বাচন অনেকটাই বিএনপি–জোট বনাম জামায়াত–জোটের মধ্যে হবে। এখন যদি সমঝোতা বা জোটের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়, তাহলে দলগুলোকে অন্য পক্ষ আরও বেশি প্রলোভন দিতে পারে। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। তাই এখনই সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত না করাটাও রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।

অঘোষিত দ্বৈরথ

জামায়াতসহ আট দলের প্রচেষ্টার বিপরীতে বিএনপিও নির্বাচনী মিত্র বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তাদের নজর ধর্মভিত্তিক দলগুলোর দিকে। এ নিয়ে অঘোষিত দ্বৈরথ চলছে।

এরই মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এবং ইসলামী ঐক্য জোট (একাংশ) বিএনপির সঙ্গে আছে। মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস অভিন্ন কর্মসূচিতে জামায়াতসহ আট দলে যুক্ত আছে। তবে বিএনপি মাওলানা মামুনুল হকের দলকে পাশে পেতে চায় বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নীতিগত আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত ‘ইসলামি দলগুলোর ভোট এক বাক্সে’ আনার বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো রূপরেখা আলোচনার টেবিলে গড়ায়নি। নির্বাচনের তফসিলের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।

পাশাপাশি আলেম–ওলামাদের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মানুষের ভোট নিজেদের দিকে নিতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি। এ জন্য হেফাজতে ইসলামের একাংশের সঙ্গে বিএনপির একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে। সেসব অনুষ্ঠানে গিয়ে জামায়াতের সমালোচনা করে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে।

জামায়াত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকটি দলের সঙ্গে সমঝোতার পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বী, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ীসহ অন্য পেশার কাউকে কাউকে প্রার্থী করা বা তাদের সমর্থন দেওয়া হতে পারে। আসন সমঝোতা না করে অনেক প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার কৌশলী ভূমিকাও নিতে পারে জামায়াত। এ ক্ষেত্রে বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিত প্রভাবশালী প্রার্থীরাও জামায়াতের বিবেচনায় থাকবেন কি না; সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।

প্রশাসনে রদবদলেও নজর জামায়াতের

আসন সমঝোতার পাশাপাশি প্রশাসনিক রদবদলের দিকেও কড়া নজর রয়েছে জামায়াতের। এ জন্য দলটি সরকার, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক এবং রাজনৈতিক বক্তৃতা–বিবৃতিতে বারবার ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’–এর প্রসঙ্গ আনছে। দলটি চায় সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে প্রশাসনিক রদবদলে যতটা সম্ভব ভারসাম্য আনতে।

গত বুধবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিলের পর লটারির মাধ্যমে যেন মাঠ প্রশাসনে কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নের ব্যবস্থা করা হয়।

তবে অনেকে মনে করছেন, সরকারকে চাপে রেখে নিজ দলের অনুসারীদের প্রশাসনিক পদে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এটি জামায়াতের একটি কৌশল।

আট দলের কৌশল

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারির পর অনেকেই ধারণা করেছিল, জামায়াতসহ আট দল অভিন্ন কর্মসূচি থেকে সরে আসবে। কিন্তু নতুন করে ‘বিভাগীয় সমাবেশ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলগুলো। ঢাকা বাদে অন্য বিভাগগুলোতে এই সমাবেশ শুরু হবে ৩০ নভেম্বর। রাজশাহী দিয়ে শুরু হবে এই সমাবেশ আর ৬ ডিসেম্বর সিলেটে গিয়ে শেষ হবে।

রাজনীতি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এখন মাঠের কর্মসূচি দিয়ে সরকারের ওপর চাপ ধরে রেখে ‘রাজনৈতিক সুবিধা’ নিতে চায় জামায়াত। বিভাগীয় কর্মসূচির মাধ্যমে তারা সারা দেশে সংস্কার বিষয়ে তাদের অবস্থান জানাতে চায়। পাশাপাশি বিএনপি যে সংস্কারের বিপক্ষে, এই আলোচনাও জারি রাখতে চায়। এটাও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পক্ষকে চাপে রাখার একটা কৌশল।