বন্দরনগরী ও জেলা চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে এখন পর্যন্ত বিএনপির মনোনয়ন ঘোষণা বাকি থাকায় ফাঁকা রয়ে গেছে ৫টি আসন। আরেকটি আসনে জোটের মনোনয়ন নিশ্চিত। ফাঁকা ৫টি আসনে বিএনপির কে কে মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন এ নিয়ে আলোচনা গুঞ্জন তুঙ্গে।
তাছাড়া চট্টগ্রামে ১০টি আসনে ধানের শীষের মনোনয়ন ঘোষণা করা হলেও, বিএনপির কোনো কোনো প্রার্থী নিয়ে দলের তৃণমূলে গ্রুপিং কোন্দল দিন দিন তীব্রতর হয়ে উঠছে।
এমনকি বিএনপির বাইরেও সমমনা দল বা সংগঠনগুলোর মাঝে রয়েছে বিতর্ক এবং মনোনয়ন বঞ্চনা-অবহেলায় ক্ষোভ-অসন্তোষ। কোনো কোনো জায়গায় দলের চরম দুঃসময়ের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতারা মূল্যায়ন না পাওয়া এবং আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ছায়ায় আশ্রিত নেতারা মনোনয়ন লাভের কারণে প্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিচক্ষণ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের প্রত্যাশায় তাকিয়ে আছেন দলের উপযুক্ত মূল্যায়নের দাবিদার এবং মনোনয়ন বঞ্চিত বিএনপির সমমনা বা সম্ভাব্য ভোটের জোট সঙ্গীরা। অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিএনপির ভোটসঙ্গী বা জোটসঙ্গীদের সমন্বয় করে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
প্রশ্ন উঠেছে, চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলাম অর্থাৎ কওমী দেওবন্দী সহিহ ইসলামী ধারাটি জনসমর্থনের বিবেচনায় যে একটি বড়সড় শক্তি, তাকে বিএনপির কেন এই উপেক্ষা অবহেলা?
ইসলামের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবার আলেম-ওলামা, মশায়েখ থেকে কাউকেই বিএনপির জোটসঙ্গী বা মনোনয়নে সঙ্গী না করায় আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতার আশাভঙ্গ হয়েছে। কোনো কোনো আসনে বিএনপির অযোগ্য, বিতর্কিত ও দুর্বল প্রার্থীর সুযোগ কাজে লাগাতে ভোটের মাঠে তৎপর রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রত্যক্ষ সহযোগী ও অর্থ যোগানদাতা এস. আলমের তল্পিবাহক কারো কারো হাতে ধানের শীষ শোভা পাচ্ছে! এমনকি এস. আলমের বহুল আলোচিত বহিস্কৃত বিএনপির একাধিক নেতাকে আবারও দলে ফিরিয়ে এনে মনোনয়ন দেয়ায় এলাকায় ক্ষোভ-অসন্তোষ বিরাজ করছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের টেকনাফ থেকে শুরু করে সর্ব উত্তর-পশ্চিম দিকের মীরসরাই উপজেলা পর্যন্ত অনেকগুলো এলাকায় হেফাজতে ইসলামের শক্ত অবস্থান রয়েছে। অরাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সহিহ ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত এই সংগঠনের প্রতি জনসমর্থন এবং ভোটব্যাংক আছে উল্লেখযোগ্য। অথচ এই পুরো অঞ্চলটিতে হেফাজতের সমর্থিত একজন প্রার্থীকেও বিএনপি জোটসঙ্গী বা ভোটসঙ্গী করেনি। এ নিয়ে হেফাজতের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ হতাশা প্রকাশ পেয়েছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বলা হয় জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির মজবুত ঘাঁটি। ইসলামপন্থীদের মধ্যে আবার হেফাজত তথা কওমী-দেওবন্দী ধারার আলেম-ওলামা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ইমাম, খতিবসহ তাদের সমর্থকদের বিরাট ভোটব্যাংক রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজত বা কওমী ধারার কেউই বিএনপির জোটসঙ্গী বা ভোটসঙ্গী না থাকায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচ জেলা তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামের এক কোটিরও বেশি ভোটারের মাঝে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। চট্টগ্রাম জেলার ১৬টি আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৬৮ লাখ ৩৬ হাজার।
যাদের বেশিরভাগই ইসলামী ধারার চিন্তা-চেতনাকে মনে প্রাণে লালন ও ধারণ করে থাকেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক নির্বাচনী এলাকায় হেফাজতের ভোটব্যাংক এবং জনসমর্থন রয়েছে বড়সড়।
এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই), চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি), চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী), চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া), চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী), কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) এবং কক্সবাজার-৩ (কক্সবাজার সদর-রামু ঈদগাঁও)।
হেফাজতে ইসলামের অন্যতম প্রভাবাধীন এলাকা বিশেষত চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনটিতে হাসিনার শীর্ষ অলিগার্ক এস. আলমের দোসর হিসেবে চিহ্নিত ও দলের ভেতরেই বিতর্কিত মোহাম্মদ এনামুল হক এনামকে মনোনয়ন দেয়ায় বিএনপির তৃণমূলের একটি বড় অংশসহ স্থানীয় আলেমসমাজ ক্ষুব্ধ এবং অসন্তুষ্ট।
তারা চান বিতর্কের ঊর্ধ্বে ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের গ্রহণযোগ্য প্রার্থী। অন্যথায় বিকল্প চিন্তা করছেন বলে জানান তারা। পটিয়া আসনে বিএনপির জোটসঙ্গী বা ভোটসঙ্গী হিসেবে দলের অধিকাংশের কাছেই এবং আলেম-ওলামাদের গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হিসেবে এলাকাবাসী দেখতে চাইছেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব বিশিষ্ট লেখক গবেষক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে। তিনি নির্বাচনী মাঠে আছেন আগে থেকেই।
অন্যদিকে ধানের শীষের উপযুক্ত প্রার্থী ঘোষণায় দলের ব্যর্থতার কারণে জামায়াতে ইসলামী এ সুযোগটির সদ্ব্যবহার করবে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জানান।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পরপরই আগস্ট ২৪ইং আওয়ামী অর্থ যোগানদাতা এস. আলমের ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে পটিয়ায় বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী মোহাম্মদ এনামুল হক এনাম সেপ্টেম্বর ২৪ইং বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন। ৩০ ডিসেম্বর ২৪ইং চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে এনামের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা মানববন্ধন করেন।
দলের তৃণমূল কর্মীরা জানান, বিএনপির দুঃসময়ে যেসব নেতাকর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছেন এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের পরিবর্তে যখন কোনো সুবিধাবাদী মনোনয়ন পেয়ে যায় সেটি দুঃখ ও হতাশাজনক। বিতর্কিত প্রার্থীর কারণে নির্বাচনে পটিয়া আসনে জেতা বিএনপির জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
বিতর্কিত প্রার্থীর পরিবর্তে ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকেই বেছে নিবেন তরুণ ভোটাররা। বিশেষ করে তরুণ এবং কওমী ধারার ভোটসংখ্যা এবার নির্বাচনী ফলাফলে বড় ফ্যাক্টর হবে। তারা খুবই সচেতন। এ অবস্থায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো চাইলে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে। তাদের কৌতূহলী দৃষ্টি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিকেই।