Image description

রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ-সদস্য দীপংকর তালুকদারের রয়েছে অঢেল সম্পদ। পাঁচবার এমপি ও এক মেয়াদে প্রতিমন্ত্রী হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন তিনি। আর এজন্য করেছেন ক্ষমতার অপব্যবহার, সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি। তিনি দলীয় নেতাকর্মী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি সিন্ডিকেট। দুদক রাঙামাটি সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক জাহিদ কালাম বলেন, দীপংকর তালুকদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।

২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন দীপংকর তালুকদার। ৫ মেয়াদে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। অর্জন করেছেন বিপুল সম্পদ। যার সিংহভাগই অবৈধ, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত, ঘুস, সরকারি অর্থ লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন জায়গায় একাধিক মামলাও হয়েছে দীপংকরের বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।

২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয় দীপংকরের বিরুদ্ধে। দুদক রাঙামাটি সমন্বিত কার্যালয় জানিয়েছে, দীপংকরের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অভিযোগপত্রে রাঙামাটির ১০ উপজেলার পাহাড়ি-বাঙালি মিলে ১০ জনের স্বাক্ষর রয়েছে। তবে তারা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন। এ অভিযোগপত্রে দীপংকরের সহযোগী রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা, অংসুইপ্রু চৌধুরী, পরিষদের সাবেক সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক রেমলিয়ানা পাংখোয়ার বিরুদ্ধেও হাজার কোটি টাকা লুটপাটসহ বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর তদন্তে নেমেছে দুদক।

অভিযোগে বলা হয়, দীপংকর প্রায় ৩০ বছর সংসদ-সদস্য থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। নামে-বেনামে ভুয়া প্রকল্পে আত্মসাৎ করেছেন শতকোটি টাকা। উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের ঘুস। ২০১৫ থেকে ২০২৪-এর জুন পর্যন্ত রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে বিভিন্ন নিয়োগে ঘুস নিয়েছেন শতকোটি টাকা। এ সময়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে হাতিয়ে নেন কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন দপ্তরে বদলি করে ঘুস নিয়েছেন ২০-২৫ কোটি টাকা। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে সরকারি বরাদ্দের খাদ্যশস্য থেকে আত্মসাৎ করেছেন ১৫-২০ কোটি টাকা। ২০১৫ ও ২০১৯ সালে পরপর দুদফায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে চেয়ারম্যানসহ ১৫ সদস্য নিয়োগের মাধ্যমে আদায় করেছিলেন ৭০-৮০ কোটি টাকা।

দৃশ্যমান যত সম্পদ : দীপংকরের রাঙামাটি শহরের চম্পকনগরে ৫ তলা বিলাসবহুল পাকা বাড়ি, বনরূপা এলাকায় ৬ তলাবিশিষ্ট একটি সুরম্য ভবন, ঢাকার সোবাহানবাগ এলাকায় ৭ তলাবিশিষ্ট একটি বিশাল বাড়ি, পূর্বাচলে প্লট, রাঙামাটি সদরের বড়াদম ও রাঙাপানি মৌজায় বিশাল জমি, রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দ্যা ইউনিয়নে বিশাল বাগানসহ বিপুল সম্পদ ও ব্যাংকে শতকোটি টাকা রয়েছে বলে অভিযোগে বিস্তারিত তথ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, দীপংকরের রাঙামাটি শহরের চম্পকনগরে ‘দীপালয়’ (হোল্ডিং নং-৩৫৩/১) নামে বিলাসবহুল বাসভবন রয়েছে। ১০২নং রাঙাপানি মৌজার রাঙামাটি শহরের বনরূপা এলাকায় ‘কল্পতরু কনভেনশন হল’ নামে আরেকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেন তিনি। এ ভবনটির নির্মাণ ব্যয়ও কয়েক কোটি টাকা। ভবনটির নির্মাণকাজ বর্তমানেও চলমান। রাজধানীর মোহাম্মদপুর শুক্রাবাদ মৌজার সোবহানবাগ নাভানা, নিউ বারী প্রেস, হোল্ডিং নং-৪/১/এ, ফ্ল্যাট নং-সি-১০, ১১তম তলায় রয়েছে একটি দামি ফ্ল্যাট। পূর্বাচল, নিউটাউন, রাজউক প্লট নং-০০৯, কালীগঞ্জ, গাজীপুর এলাকায় আছে ৯ কাঠা ২৫ ছটাক ৩২ বর্গফুটের প্লট। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) হাটহাজারী অনন্যা আবাসিক এলাকায় (চউক প্লট নং-ডি-৪৮৭) ৫ কাঠা জমি। এছাড়া দীপংকরের মালিকানায় রাঙামাটি সদরের ১০৭নং বড়াদম মৌজায় (হোল্ডিং নং-২২) ৫ একর জমি, ১০২নং রাঙাপানি মৌজায় ৩৪২৮ দশমিক ২০ বর্গফুট জমি, ১০৪নং ঝগড়াবিল মৌজায় ২ দশমিক ২৩ একর জমি এবং রাজস্থলী উপজেলার ৩৩১নং গাইন্দ্যা মৌজায় ২১ একর জায়গায় তার পাল্পউড বাগানের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে রাজস্থলীর গাইন্দ্যা মৌজার পাল্পউড বাগানের জায়গাটি ২১ একর বলা হলেও স্থানীয়দের ধারণা এর পরিমাণ হবে দ্বিগুণের অধিক।

ভারতের কলকাতায় দীপংকরের ১০ তলাবিশিষ্ট একটি বাড়ি রয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় তার পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা দেখিয়েছিলেন দীপংকর, যা বাস্তবে আকাশ-পাতাল তফাত। তার স্ত্রী, ছেলেসহ পরিবারের সদস্যদের নামেও বিপুল সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে।

দীপংকরের সহযোগী হয়ে কাজ করেছিলেন জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা লীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারাও বনে গেছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। বর্তমানে তাদের অনেকে আত্মগোপনে। ৫ আগস্টের পরই গা ঢাকা দিয়েছেন তারা।

দীপংকর তালুকদার টানা প্রায় ২৮ বছর ধরে আগলে রেখেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদটি। ১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় সংসদের ২৯৯-পার্বত্য রাঙামাটি আসনে দলীয় প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন টানা সাতবার। তার মধ্যে হেরেছেন দুইবার, নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচবার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

এদিকে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট দীপংকরের প্রকাশ্য সম্পদের বাইরেও বিপুল সম্পত্তি থাকার প্রমাণ পেয়েছে। এর পরই দীপংকরের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পে অনিয়মসহ দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগে তদন্তে নেমেছে দুদক। গত বছরের ২ অক্টোবর দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশন সভা থেকে তদন্তের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে দলটির আরও তিন নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী, বৃষ কেতু চাকমা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মো. মুছা মাতব্বর এবং সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য রেমলিয়ানা পাংখোয়ার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চালানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে দুদকের।

এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করা হলেও দীপংকর তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। দুদক রাঙামাটি সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক জাহিদ কালাম বলেন, দীপংকর তালুকদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়েছি। অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।