Image description

মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বিশ্বনাথপুর-শিবপুর সড়কে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে একটি নির্মাণাধীন বাগানবাড়ি দেখালেন স্থানীয় আবুল হোসেন। বাহারি কারুকার্যখচিত রাজকীয় ঢঙের বাগানবাড়িটি বানাচ্ছেন মোরশেদ আলম লিপু। মাত্র ২৮ বছর বয়সী লিপুর দৃশ্যমান কোনো আয়ের তথ্য এলাকাবাসীর জানা নেই। অথচ তিনি কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বাগানবাড়িতে পাশাপাশি তিনটি আলিশান ভবন করেছেন। তৈরি করেছেন রাজকীয় ফটক। তার আছে কোটি টাকা ব্যয়ের কৃষি খামার, গরুর খামার ও মাছের ঘের। লিপু চলাফেরা করেন হালফ্যাশনের বিলাসবহুল গাড়িতে। তার বহরে থাকে আট থেকে ১০টি প্রাইভেট গাড়ি ও ২৫ থেকে ৩০টি মোটরসাইকেল। থাকে তাগড়া তাগড়া বডিগার্ডের দল। লিপু যেন স্থানীয় যুবকদের ক্রেজ। শুধু নিজেই নয়; আত্মীয়স্বজনের নামেও রয়েছে বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। সবাই জানতে চান তার শনৈ শনৈ উন্নতির রহস্য কী? কেউ কেউ মনে করছেন তিনি বুঝি রূপকথার সেই আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন; ‘আদেশ’ করা মাত্রই জিন তার সব করে দিচ্ছে। কিন্তু লিপুর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্যানুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। লিপু আসলে একজন অনলাইন জুয়ার নিয়ন্ত্রক। মেহেরপুরে সেই অনলাইন জুয়ার রাজধানী হলেও হেডকোয়ার্টার সুদূর রাশিয়ায়। সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয় অনলাইন জুয়ার কারবার।

মুজিবনগর উপজেলার আরেক গ্রাম কোমরপুর। একসময়ের হতদরিদ্র মানুষের বসবাস থাকা ওই গ্রামটির পরিচিতি এখন কোটিপতিদের গ্রাম হিসেবে। এই গ্রামে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মইনুদ্দিন। স্থানীয়দের কাছে তার পরিচিতি ‘ময়না মেম্বার’ নামে। তিনি আবার মহাজনপুর ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা। ময়না মেম্বারের অপর ভাই মশিউর রহমান মহাজনপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও মুজিবনগর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি। ময়না মেম্বার বর্তমানে মহাজনপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কোমরপুরে ময়না মেম্বারের তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি। তিনটিই যেন রাজপ্রাসাদ। মেহেরপুর শহরের নীলমণি হল পাড়ায় মিমি বেকারির পাশে ছয়তলা একটি বিলাসবহুল ভবনও আছে তার। কোমরপুর স্কুলপাড়ায় বানাচ্ছেন আরেকটি নতুন বাড়ি। স্থানীয় তথ্য বলছে, তিনিও অনলাইন জুয়ার এজেন্ট।

শুধু ময়না মেম্বার বা লিপুই নন, মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর ও গাংনী—এ তিন উপজেলায় অনলাইন জুয়ার এজেন্ট, মাস্টার এজেন্ট ও সাব-এজেন্ট আছেন তিন শতাধিক। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক। একদিকে এজেন্টরা যেমন কোটিপতি, তেমনি অনলাইন জুয়া খেলে সর্বস্ব হারাচ্ছে বহু তরুণ যুবক। তারা অনলাইন জুয়া খেলার টাকা সংগ্রহের জন্য চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

যেভাবে শুরু: মেহেরপুরের মানুষ কীভাবে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়েছে, তার সঠিক বিবরণ পাওয়া যায়নি। লোকমুখে জানা যায়, মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর ও কোমরপুর গ্রামের প্রায় অর্ধশত যুবক রাশিয়া প্রবাসী। তারাই সেখান থেকে অনলাইন জুয়ার কারবার করতে স্থানীয় তরুণদের প্রলুব্ধ করে। তাদের মাধ্যমে সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় অনলাইন জুয়া। স্থানীয়রা আরও জানান, ২০১৭ সালের শুরুতে মুজিবনগর উপজেলার জনৈক মাহফুজুর রহমান ওরফে নবাবের হাত ধরে মেহেরপুরে অনলাইন জুয়া শুরু করেন। তার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে জেলার গ্রামে গ্রামে, পাড়ামহল্লা ও বাড়িতে বাড়িতে। ‘ওয়ান এক্সবেট, মেলবেটসহ শতাধিক জুয়ার সাইট ব্যবহার করে চলছে অনলাইন জুয়ার কার্যক্রম। এসব জুয়া নিয়ন্ত্রণ হয় সুদূর রাশিয়া থেকে। জুয়ার চ্যানেল পরিচালনা করে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে রাশিয়ায়। সেখানে রাশিয়ান লোকদের সঙ্গে মিলে জুয়া পরিচালনা করে কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি। যাদের কয়েকজনের গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরে।

এ ছাড়া কভিড লকডাউনের সময় এই জুয়ার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে জুয়ার বিস্তৃতি ঘটে বেশি। ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর অনলাইনে জুয়ার কারবারের সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা হলো অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মুরশিদ আলম লিপু, স্বপন মাহমুদ, নাজমুল হক, আসলাম উদ্দিন, শিশির মোল্লা, সাদিক, মাসুম রানা, মাহফুজুর রহমান নবাব ও নবাবের স্ত্রী মনিরা আক্তার মিলি। তখন প্রথম মেহেরপুরে অনলাইন জুয়া এবং অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্ট সম্পর্কে তথ্য সামনে আসে। ওই সময় সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সিআইডির নজরদারির ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন খেলা কেন্দ্র করে তারা রাশিয়াভিত্তিক বেটিং ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে জুয়ার কারবার পরিচালনা করেন। আর লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট সিম। মেহেরপুরের কয়েকটি বিকাশ নগদ এজেন্ট ও ডিপোর ম্যানেজারের সম্পৃক্ততার কথা জানায় সিআইডি।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শুধু মেহেরপুর জেলা থেকে মাসে ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় অনলাইন জুয়ায়। অনলাইন জুয়ার এই আসরে প্রথম পর্যায়ে কেউ কেউ লাভবান হয়ে পরবর্তী সময়ে লোভে পড়ে সহায়-সম্বল খুইয়েছেন। অনেক অনলাইন জুয়াড়ি লেনদেন নিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছেন। এলাকায় গুঞ্জন আছে, এজেন্ট ব্যাংকিং এজেন্টকে গুলি করে হত্যার নেপথ্যেও ছিল অনলাইন জুয়া।

পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন মন্ত্রীপত্নী মোনালিসা:

২০২১ সালে সিআইডি কর্তৃক গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের একজন মন্ত্রীর স্ত্রীর তদবিরে জামিন হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তারা ওই মন্ত্রীর স্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় অনলাইন জুয়ার কারবার পুরো জেলায় বিস্তৃত করেন। যারা জুয়া ছড়াতে কাজ করেন, তারা হলেন মুজিবনগর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আমাম হোসেন মিলু, তার ভাতিজা মেহেরপুর ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সালাম বাঁধন, মিলুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মইনুদ্দিন ওরফে ময়না ও স্বপন মাহমুদ। এই চক্রটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী মোনালিসাকে হীরার হারসহ নিয়মিত উপঢৌকন উপহার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিশন দিতেন। তার ছত্রছায়ায় দ্রুত জেলায় বিস্তার হয় অনলাইন জুয়ার কারবার। জুলাই বিপ্লবের পর আগের পৃষ্ঠপোষকের স্থলে শুধু নতুন পৃষ্ঠপোষক এসেছে স্থানীয়দের দাবি। এখন স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতা অনলাইন জুয়ার মূল পৃষ্ঠপোষক।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বৃহস্পতিবার আমাম হোসেন মিলুর মেহেরপুরের বাড়িতে অনলাইন জুয়ার এজেন্টদের মিটিং হতো। সেখান থেকে নির্ধারিত হারে চাঁদা তুলে প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও কিছু গণমাধ্যম কর্মীকে দেওয়া হতো।

পুলিশ বলছে, গত কয়েক বছরে জেলায় পৃথক ৪৮টি মামলায় মোট ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করে সোপর্দ করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে জামিনে বেরিরে ফের আগের কারবারে ফিরে যায়। ইতঃপূর্বে মেহেরপুর জেলা থেকে গ্রেপ্তারকৃত ১৪ জন শীর্ষ অনলাইন জুয়াড়িকে অনলাইন জুয়ার ‘মাফিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। নিয়মিত মামলার পাশাপাশি তাদের অর্থ পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তদন্ত করতে মেহেরপুর জেলা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেও (বিএফআইইউতে) পাঠানো হয়। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে, তারা হলেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার গাড়াডোব গ্রামের কিয়ামুদ্দিনের ছেলে আনোয়ার, গাংনী পৌর এলাকার আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে শহীদুজ্জামান শিপু, মেহেরপুর সদর উপজেলার বলিয়ারপুর গ্রামের মুসা আলীর ছেলে মাসুদ রহমান, মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের সোনা গাইনের ছেলে মাহফুজুর রহমান নবাব, শিবপুর গ্রামের জিনারুল গাজীর ছেলে লিপু গাজী ওরফে মোরশেদ আলম লিপু, কোমরপুর গ্রামের মজিবুর রহমানের ছেলে মুকুল ইসলাম, গোপালপুর গ্রামের বিল্লাল গড়াইয়ের ছেলে দেলোয়ার হোসেন দিপু, মহাজনপুর গ্রামের মাদার মাস্টারের ছেলে মোস্তাক নাহিদ অনিক, কোমরপুরের নাটুদহ গ্রামের সাহাজুল সরদার ওরপে বিলু সরদারের ছেলে শামীম রেজা, কোমরপুর গ্রামের ইমাদুল হকের ছেলে রাজু আহম্মদ রাজন, কোমরপুর গ্রামের আনারুল ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলাম রুবেল, কোমরপুরের নাটুদহ গ্রামের মধু হালদারের ছেলে প্রসেনজিৎ হালদার, মহাজনপুরের আব্দুর রশিদের ছেলে সাদ্দাম হোসেন ও শিবপুর গ্রামের শাহাজুল শেখের ছেলে বিজয় শেখ।

জড়িয়েছে পুলিশও:

মেহেরপুর জেলার তিন থানা পুলিশেরও বেশকিছু অপেশাদার ও লোভী কর্মকর্তা অনলাইন জুয়ায় জড়িয়েছেন। পুলিশ সদর ও রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় থেকে নানাভাবে সতর্ক করার পরও তারা অনলাইন জুয়ার কারবারে সম্পৃক্ত রয়েছেন। সম্প্রতি অনলাইন জুয়ায় জড়িত এক পুলিশ সদস্যের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। ওই কর্মকর্তাকে আগস্ট-পরবর্তী সময়ে মৌলভীবাজারে বদলি করা হয়েছে। আলোচিত ওই কর্মকর্তা হচ্ছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজমল হোসেন। তিনি তার এক অধস্তন এসআই সাহেব আলীর সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজমল হোসেন নিজেকে ‘অনলাইন জুয়া চ্যানেলের একক মালিক’ বলেও দাবি করে। এ ঘটনায় জেলাজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় তৈরি হয। ওই কল রেকর্ডে তৎকালীন মুজিবনগর থানায় কর্মরত এসআই ইকবালসহ কয়েকজন এসআই এমনকি কনস্টেবলরাও সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিলে। এসআই ইকবাল বেশ কয়েকটি অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনিও নতুন গাড়ি কিনে তাতে চলাফেরা করেন। তার বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করলে এই প্রতিবেদককে ‘বাঁশ দিয়ে রাস্তায় টানিয়ে রাখার হুমকি দেন।’

গ্রামভিত্তিক অনলাইন জুয়ার এজেন্ট যারা:

মুজিবনগরের কোমরপুর গ্রামের অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টরা হলেন ময়না মেম্বার, মাদার মাস্টার, মাবুদ মেম্বার, জামান মাস্টার, মুকুল, শামীম, প্রসেনজিৎ হালদার, উজ্জ্বল, রুবেল, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সাইফুল ইসলাম, মজিবরের ছেলে শুভ, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ সভাপতি বাঁধনের মামাতো ভাই রাশিয়া ফেরত অনিক, ছোট মিঠু, বাসার বিশ্বাস ও তার ছেলে সজীব, ভোলাসহ অনেকে।

গোপালপুর গ্রামের অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টরা হচ্ছেন নুরুল মাস্টার ওরফে লালন মাস্টার, স্বপন মাহমুদ, সিসিটিভি বিক্রেতা স্বপন, দেলোয়ার হোসেন দিপু, শিশির, আফ্রিকা ফেরত বিল্লাল, রয়েল সাকিবসহ অনেকে।

যতারপুর গ্রামের অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টরা হচ্ছেন ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি বাঁধন, সোহাগ (যতারপুর ব্রিজের নিচে রড সিমেন্টের দোকান রয়েছে), কটা, মাসুম, আশিক, আওয়ামী লীগ নেতা ও মুজিবনগর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আমাম হোসেন মিলু ও তার ভাই শিলুসহ অনেক।

ইসলামপুর গ্রামের অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টরা হচ্ছেন জনি ও মেহেদী পুরোনো এজেন্ট হলেও বর্তমানে নতুন অনেক এজেন্ট তৈরি হয়েছে। মহাজনপুর গ্রামের ক্যাসিনো এজেন্টরা হচ্ছেন হেলাল, মিঠু ও হিটু, গাংনীতে রাসেল, শিপু ও সজীব। জানা গেছে, শিপু মূলত অনলাইন জুয়ার খেলোয়াড়। জুয়া খেলে সে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে।

আলমপুরের মানিক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, বামুন্দি বাজারের রাসেল মিয়া, হেমায়েতপুর বাজারে আনোয়ার হোসেন, মেহেরপুর শহরের স্যামসাং শোরুমের সাবেক কর্মচারী ইমরান, মুজিবনগরে শিবপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা রফা গাইনের ছেলে পরাগ। মেহেরপুর পৌর শহরের শেখ পাড়ার মো. নিপুন, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের সভাপতি মো. নাসিম খান, আশিকুর রহমান আশা ও সজল শেখ।

এদের মধ্যে ২০২৪ সালে দুদকের একটি দল মেহেরপুর যায় ছয় অনলাইন কারবারির জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের উৎস সম্পর্কে তদন্ত করতে। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের জন্য সেই দল যাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছিল, তারা হলেন শেখ পাড়ার আমানুল্লাহর ছেলে আশিকুর রহমান আশিক, মান্নান খানের ছেলে ফাহাদ খান, গোপাল শেখের ছেলে সুজন শেখ, মারুফ হোসেন পনির, আফসারের ছেলে শিশির ও মৃত জালাল মীরের ছেলে শিপন মীর।

যেভাবে টাকা পাচার হচ্ছে:

অনলাইন জুয়ার টাকা মূলত পাচার হয় অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। আর এই হুন্ডিতে সহায়তা করা হয় দুটি চ্যানেল থেকে। একটি হলো মোবাইল ব্যাংকিং, অন্যটি কোর ব্যাংকিং ডিপোজিটের অনলাইন ট্রান্সফারে। এই দুই মাধ্যমে কোর ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে টাকা চলে যাচ্ছে হুন্ডি কারবারিদের হাতে। হুন্ডির মাধ্যমে এই টাকা চলে যাচ্ছে দুবাই, মালয়শিয়া, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর ও লেবাননে। সেখান থেকে টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে রূপান্তরিত হয়ে ইউএসডিটি হয়ে ভার্চুয়াল রূপে বাংলাদেশে ফিরে আসে।

আবার অন্য একটি প্রক্রিয়া হলো জুয়া সাইটের দেশীয় এজেন্টরা প্রথমে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে। এরপর ওই টাকা অনলাইনভিত্তিক ‘বাইন্যান্স’ নামক অ্যাপে বিনিয়োগ করা হয়। সেখানে ডিলাররা টাকাকে ডলারে রূপান্তর করে বিনিয়োগ করে। এরপর তা ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েনে রূপান্তর করে জুয়ার সাইট মালিকের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

ইউএসডিটি হয়ে যেভাবে জুয়াতে:

হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সির রূপ নিয়ে ভার্চুয়াল ইউএসডিটি হয়ে এজেন্টের অ্যাকাউন্টে ফেরত আসে। কিন্তু ওই টাকা বাংলাদেশে থাকছে না। বাংলাদেশ থেকে টাকা তোলাও সম্ভব নয়। রাশিয়া থেকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত বেটিং সাইটগুলোতে এজেন্টরা প্রি-পেমেন্ট হিসেবে এই ভার্চুয়াল ইউএসডিটি পান। সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত বেটিং সাইটগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে দেশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নগদ, বিকাশ, রকেট, উপায়সহ বিভিন্ন এজেন্ট সিম। এজেন্ট সিমগুলোতে যখনই কোনো জুয়াড়ি জুয়ার অ্যাপসের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে বাংলাদেশি টাকা ডিপোজিট করে, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে এজেন্টের অ্যাকাউন্ট থেকে ইউএসডিটি মাইনাস ছুঁতে থাকে। এভাবে যখন ইউএসডিটি শূন্য হয়ে যায়, তখনই এজেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং থেকে তার উত্তোলিত টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে ইউএসডিটি রিফিল করে। এভাবেই চক্রাকারে চলতে থাকে দিনের পর দিন অর্থ পাচার।

মূল নিয়ন্ত্রণ রাশিয়া থেকে:

জানা গেছে, এজেন্ট হলেও অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত রাশিয়া থেকে। মুজিবনগর উপজেলার বাসিন্দা অর্ধশত প্রবাসী সেখান থেকে জুয়ার সাইট নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা জুয়ার সাইট ও অ্যাপস স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ব্যবহার করে প্রত্যেক এজেন্ট মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন। রেডি অ্যাপস ও ম্যানেজমেন্ট অ্যাপসের মাধ্যমে মেহেরপুরে দীর্ঘদিন থেকে অনলাইন জুয়া চলে। দুটি অ্যাপসই রাশিয়ার তৈরি। এর মধ্যে রেডি অ্যাপস রাশিয়া থেকে আর ম্যানেজমেন্ট অ্যাপস আর্থিক লেনদেন বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত হয়। ম্যানেজমেন্ট অ্যাপসটি রাশিয়া থেকে পরিচালিত রেডি অ্যাপসের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো কাজ করতে পারে না। ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ মূলত বিভিন্ন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের এজেন্ট সিম ব্যবহার করে মেইন সাইট, এজেন্ট ও জুয়াড়িদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত করে। সূত্র জানিয়েছে, ম্যানেজমেন্ট অ্যাপের মেইন চ্যানেল মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপস নগদ। এ ছাড়া সেকেন্ডারি চ্যানেল হিসেবে রয়েছে বিকাশ, রকেট, উপায় এবং ট্রাস্ট এজিয়াটা। মূলত ওয়ান এক্স বেট, মেলবেট, মোস্ট বেট, টি-টোয়েন্টি বেট ও টোয়েন্টি ফোর বেট অনলাইন জুয়ার সাইটগুলোর এজেন্ট ডিলারশিপ হিসেবে ভূমিকা রাখে রেডি অ্যাপ। অ্যাপটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও ডেক্সটপে ব্যবহার করা যায়।

বাংলাদেশের আইনে মানি লন্ডারিং ও এর শাস্তি:

বাংলাদেশে প্রচলিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধের শাস্তি রাখা হয়েছে অন্যূন ৪ (চার) বছর এবং সর্বাধিক ১২ (বারো) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ (দশ) লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

কয়েক এজেন্টের বক্তব্য:

অনলাইন জুয়ার এজেন্ট দুবাই প্রবাসী মাহফুজুর রহমান নবাব কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে বিএনপির রাজনীতির করি। এ কারণে আমাকে ফাঁসাতে আমাম হোসেন মিলু ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ফরহাদ হোসেন ও তার স্ত্রী মোনালিসাকে ম্যানেজ করে মিলু আমাকে এমন একটি মামলায় যাদের সঙ্গে ফাঁসানো হয়েছে, তাদের সঙ্গে আমার চলাফেরা ছিল না। যে ৯ জনের জবানবন্দির ভিত্তিতে আমাকে আসামি করা হয়, তাদের আমি চিনতামই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিয়ের পর হানিমুনে কক্সবাজার ছিলাম। সেখান থেকে ধরে এনে আমাকে ওই মামলায় আটক দেখানো হয়। এখন আওয়ামী লীগ সরকার নেই, আপনারা প্রয়োজনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা সিআইডির এসআই মুরাদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।’

কালবেলার সঙ্গে কথা হয় অপর অনলাইন ক্যাসিন এজেন্ট মোরশেদ আলম লিপুর। তিনি বলেন, ‘সিআইডিতে আমার বিরুদ্ধে কোনো মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত চলছে কি না, আমার জানা নেই। মোবাইল খুললেই পদে পদে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখা যায়, ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওতেও একই অবস্থা, এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার আগে অনলাইন জুয়া বন্ধ করা নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। আর কোন কোন চ্যানেলে, কীভাবে টাকা দেশের বাইরে যায়, সেটা সঠিক খবরও আপনারা এখন পর্যন্ত তুলে ধরতে পারেননি।’

অপর এজেন্ট দেলোয়ার হোসেন দিপুর কাছে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাকে বারবার মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। কয়দিন আগেও একটি মামলায় আমাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এসেছি। এবার আমি মামলার এজাহারকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মেহেরপুর পুলিশ সুপার, খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি এবং আইজিপির কাছে অভিযোগ করব। আর মানি লন্ডারিং ইস্যুতে সিআইডি থেকে আমাকে একবার আমার একটি সিমের বিস্তারিত দিতে বলেছিল। সেটা দেওয়ার পর আমাকে আর কিছু জানানো হয়নি।’

পুলিশের বক্তব্য:

অনলাইন জুয়ার ভয়ংকর রূপ নিয়ে জানতে চাইলে মেহেরপুর জেলা পুলিশ সুপার মাকসুদা আক্তার খানম কালবেলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ৩০(২) ধারা মোতাবেক অনলাইন জুয়ার অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাদের অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থাৎ মামলা নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিতক্রমে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হলে ওই ধারাটি অধর্তব্য করা হয়। ফলে অনলাইন জুয়ার আসামিদের গ্রেপ্তার বা তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আর মানি লন্ডারিং একটি অর্গানাইজ ক্রাইম। বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি এই ধরনের মামলা তদন্ত করে থাকে। মানি লন্ডারিং তদন্ত সিআইডি করে এজন্য আমাদের মামলাগুলো তদন্তের গতি কমার কোনো বিষয় বা সুযোগ নেই।’

বিশেষজ্ঞ মত:

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিলুর রহমান খান কালবেলাকে বলেন, ‘আইন পরিবর্তনের ফলে অনলাইন জুয়াড়ি ও জুয়ার এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না, এ কথাটা ঠিক নয়। অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সংবিধানে ও প্রচলিত বিধিবিধানে পর্যাপ্ত আইন এবং সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। সদিচ্ছা থাকলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দেশের বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে জুয়াড়ি ও ক্যাসিনো এজেন্টদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে।’

সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সিপিবি নেতা অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান বলেন, ‘অনলাইন জুয়ায় যুবসমাজ আর্থিক প্রলোভনে পড়ে রাষ্ট্রের আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। তারা রাষ্ট্রের আইন পরিপন্থি কাজ করছেন। এখন আবার দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু কিশোর কোটিপতি হয়ে উঠছে, এটা অবশ্যই দৃষ্টিকটু। কথিত আছে মেহেরপুরের একটি গ্রামের অর্ধশত যুবক রাশিয়ায় বসবাস করে। সেখান থেকে বাংলাদেশের অনলাইন জুয়াড়ি ও অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্ট এর মধ্যে সমন্বয় করে।’

যা বললেন জেলা জামাতের আমির:

মেহেরপুর জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা তাজ উদ্দিন খান কালবেলাকে বলেন, ‘জুয়া খেলা’ আমাদের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অনলাইন জুয়ার কারণে নতুন প্রজন্ম কীভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেটা কল্পনাতীত। এখান থেকেই মাদক ও নারী সংক্রান্ত অপকর্মগুলোর সূত্রপাত হচ্ছে। উচ্চাভিলাষী চিন্তাভাবনার কারণে যুবকরা পথভ্রষ্ট হচ্ছে। আমার কাছে এমন তথ্যও আছে, এই অনলাইন জুয়ার জন্য অনেকে তার বাপ-দাদার সম্পদ ও জমি বন্ধক রেখে কিংবা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমি চাই, চিহ্নিত ও প্রকৃত অপরাধীদের যেন দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা হয়। অনলাইন জুয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৃত অপরাধীদের যেন দ্রুত গ্রেপ্তার করা হোক। একই সঙ্গে অন্যায়ভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করলে আমরা সেটা প্রতিবাদ করব।’