দেশজুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। বিশেষ করে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর থেকেই নির্বাচনের ট্রেন লাইনে উঠে গেছে। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের বিষয়ে তার অনড় অবস্থান আবারো স্পষ্ট করেছেন। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে ডিসেম্বরের শুরুতে তফসিল দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সব দল গণভোটের ব্যাপারে একমত হলেও এটি সংসদ নির্বাচনের সাথে হবে নাকি আগে হবে এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ মতবিরোধ রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব কৌশলের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আসলে প্রত্যেকটি দল তাদের দলীয় স্বার্থ আদায়ে সরকারের সঙ্গে এ ধরনের দাবি নিয়ে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে দলগুলোর এমন দাবি আদায়ের কৌশল চলতেই থাকবে। সরকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলে সবাই তখন নির্বাচনী মাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে সরকারকে এক রকম চাপে রাখার চেষ্টা করবে। সরকারের কাছ থেকে দলের পক্ষে সুবিধা আদায়ের জন্য প্রতিটি দলই এ ধরনের কৌশল নিয়ে থাকে। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীও সরকারকে চাপে রেখে সুবিধা আদায়ের নানা কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আমি মনে করি, তফসিল ঘোষণার পর এসব দাবি নিয়ে কোনো দল আর কথা বলবে না। সবাই তখন নির্বাচনী মাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের মাঠে ইতোমধ্যে নেমে পড়েছে। সারা দেশে তিনশ’ আসনে তাদের মনোনীত প্রার্থীরা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই তাদের পিআর ও নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিÑ এসব একটি কৌশল মাত্র। কেননা, জামায়াত নির্বাচনের মাঠে অলরেডি নেমে পড়েছে।
দীর্ঘ ১৬ বছর দেশের মানুষ নিজেদের মতো করে ভোট দিতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের মানুষ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রর্থীরাও অনেক বছর পর একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্ততি নিচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেক দল প্রার্থী বাছাই, জোট গঠনের মতো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ইতোমধ্যে দলটি ৩০০ আসনে তাদের মনোনীত প্রার্থীর তালিকা ঘোষণা করেছে। জামায়াতের মনোনীত প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় নানাভাবে নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছেন। এছাড়া কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়েও তৎপর দলটি। ইসলামী দলগুলো নিয়ে সাত দফা দাবিতে রাজপথে থাকলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী অন্যান্য দলের সঙ্গেও নির্বাচনী সমঝোতায় আপত্তি নেই জামায়াতের। এসব দলকে পর্যাপ্ত আসন ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী প্রধানত দুটি কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ দলটির মূল লক্ষ্য আগামী জাতীয় নির্বাচনে নতুন চমক সৃষ্টি করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির বিজয় অর্জন করে যেমন চমক সৃষ্টি করেছে, জামায়াতে ইসলামীও আগামী সংসদ নির্বাচনে এমন চমক দেখাতে চায়। এজন্য দলটি এখন থেকে মানবিক ও সামাজিক কর্মকা-ের মাধ্যমে জনমত তৈরির সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় নানা দলীয় ও সামাজিক কর্মকা- চালাচ্ছেন। এর মধ্যে গত ৩১ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামী মনোনীত ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী ড. আব্দুল মান্নানের উদ্যোগে বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষায় মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানববন্ধনে ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও, ঢাকা বাঁচাও’, ‘আর নয় দূষণ, ফিরিয়ে দাও নদীর জীবন’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়া হয়। এ ছাড়াও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মানবিক কাজ হিসেবে বিভিন্ন মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজন করছে দলটি। গত ৩১ অক্টোবর জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের পক্ষে রাজধানীর মিরপুর ১৩ নাম্বারের শেরেবাংলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৫ আসনে জামায়াত আমির দলের পক্ষে প্রার্থী হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, দেশের সংখ্যালঘু ভোটারদের আকৃষ্ট করতে এবং নিজেদের পক্ষে আনতেও নানান কর্মসূচি নিচ্ছে জামায়াত।
গত দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানের পূজাম-প চষে বেরিয়েছে জামায়াতের নেতারা। সেখানে নিয়ে জামায়াত নেতারা বক্তব্যও দিয়েছেন। হিন্দুদের পূজা আর মুসলমানদের রোজার উদাহরণ দিয়ে বক্তব্য দেয়ায় এ নিয়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছে। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় হিন্দু সম্মেলনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রধান অতিথি ছিলেন। এই হিন্দু সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ডুমুরিয়া উপজেলা শাখা। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী নারী ভোটারদের টানতেও বিশেষ কৌশল নিয়েছে। জামায়াতের নারী বিভাগের কর্মী ও নেত্রীরাও চালাচ্ছেন ভোটের প্রচারণা। ইসলামী সভার নাম করে বাড়িতে বাড়িতে হয় নারীদের জমায়েত। সেই জমায়েতে ধর্মীয় আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে চলে ভোটের প্রচার। প্রচারণার এই কৌশলে একটি বিষয় পরিষ্কার