Image description

দেশের ৫১২টি রেলস্টেশনেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে বিভিন্ন জেলায় চিহ্নিত কিছু চক্র ট্রেনে মাদক, অস্ত্রসহ নিষিদ্ধ পণ্য পরিবহন করছে। রেলস্টেশনে লাগেজ স্ক্যানার ও স্ক্যানার গেটও স্থাপন করা হয়নি। এ ছাড়া রেলস্টেশন ও ট্রেনে নজরদারির জন্য রেল পুলিশের প্রয়োজনীয় জনবলও নেই।

গত রবিবার রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে অস্ত্র উদ্ধারের পর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আরো ভাবিয়ে তুলছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের অধীনে সব মিলিয়ে ৫১৫টি স্টেশন আছে। এর মধ্যে ৫১২টিতেই লাগেজ স্ক্যানার ও স্ক্যানার গেট নেই। এখন পুরোপুরি চালু রয়েছে চার শতাধিক রেলস্টেশন।

ঢাকা রেলস্টেশন (কমলাপুর), চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার রেলস্টেশনে লাগেজ স্ক্যানার স্থাপন করা হলেও এগুলো নিয়মিত ব্যবহার না করার অভিযোগ রয়েছে। গত ৪ আগস্ট কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে প্রথমবারের মতো বসানো হয় স্ক্যানার। তবে তা বসানোর দুই ঘণ্টা পরই মেশিন অচল হয়ে পড়ে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, জনবল সংকট ও কিছু অসুবিধার দরুন স্ক্যানিং মেশিন বন্ধ রাখা হয়েছে।
গতকাল শনিবার রাতে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনের মাস্টার গোলাম রব্বানী কালের কণ্ঠকে জানান, ঢাকা থেকে প্রকৌশলী যাওয়ার পর মঙ্গলবার নাগাদ এই যন্ত্র আবার চালু হতে পারে। 

তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনসহ যে কটি রেলস্টেশনে স্ক্যানার বসানো হয়েছে, সেগুলো ঠিকমতো কাজ করছে কি না অবশ্যই পরীক্ষা করা হয় এবং হবে। তবে শুধু যন্ত্র বসালেই হবে না, যেখানে পুরো স্টেশন উন্মুক্ত, সেখানে স্ক্যানার এখনই বসানো হলে ফলাফল মিলবে না। একসেস কন্ট্রোল সিস্টেম করে এসব যন্ত্র বসানোর পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। কারণ প্রায় সব স্টেশনই উন্মুক্ত।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, নিরাপত্তার জন্য সব রেলস্টেশনে বেষ্টনীও নেই। এ ছাড়া নেই নিয়মিত তল্লাশির ব্যবস্থা। ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীদের তল্লাশির মুখে পড়তে হচ্ছে না বেশির ভাগ স্টেশনে। ট্রেনেও নেই পর্যাপ্ত নজরদারি। সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এ কারণে ট্রেনে বিভিন্ন রুটে মাদক, অস্ত্র ও বিস্ফোরক বহন করা সহজ। এই সুযোগ নিয়ে অপরাধীচক্র বিশেষ করে লোকাল, মেইল, কমিউটার ট্রেনে নিষিদ্ধ পণ্য পরিবহন করছে। নিরাপত্তা নেই বলেই আন্ত নগর ট্রেনেও অস্ত্র পরিবহন করছে অপরাধীরা। এই অবস্থায় গত রবিবার রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে বনলতা এক্সপ্রেস থেকে আটটি বিদেশি পিস্তল, ১৬টি ম্যাগাজিন, ২৬টি অ্যামুনিশন, দুই কেজি গানপাউডার ও দুই কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক বহন করছিল অপরাধীরা। তবে ওই স্টেশনে দাঁড়ানো অবস্থায় ট্রেন থেকে ওই দিন অভিযান চালিয়ে এগুলো উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। তাতে সহযোগিতা করে গোয়েন্দা সংস্থা ও রেলওয়ে পুলিশ। অভিযানকালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে চারজনকে। এ আগে গত ৪ জুন ভৈরব রেলস্টেশনে বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিনসহ অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারও এক বছর আগে ওই স্টেশন থেকেই বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিনসহ অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগেও কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে একে-২২ রাইফেলসহ বিপুল ম্যাগাজিন, গানপাউডার ও বিস্ফোরক উদ্ধার করে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ। এভাবেই মাঝেমধ্যে চালান ধরা পড়লেও বেশির ভাগ চালান ধরা পড়ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ট্রেনে মাদক, অস্ত্রের চালান প্রতিরোধে সব রেলস্টেশনে লাগেজ স্ক্যানিং মেশিন স্থাপন ও পর্যাপ্ত রেল পুলিশ নিয়োগের আবেদন করেছিল রেলওয়ে পুলিশ। তার বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকা রেলওয়ে জোনে পুলিশের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রেলপথে মাদক, অস্ত্রের চালান ধরা পড়ছে। ১০টি প্রশাসনিক জেলার ওপর দিয়ে চলা ট্রেন ও এসব জেলার সব রেলস্টেশনের নিরাপত্তা রক্ষায় তাঁর অধীন রেল পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এক বছর আগে পুলিশ সদর দপ্তরে আরো ৭০০ জনবল দেওয়ার এবং যমুনা পূর্ব ও পদ্মা উত্তর রেলস্টেশন স্থাপনের প্রস্তাব করেছিলাম। এখনো কোনো ফল হয়নি। এখন আমাদের ঢাকা জোনে জনবল আছে মাত্র ৪৫০ জন। উন্মুক্ত রেলস্টেশনে এত কম জনবল দিয়ে নিরাপত্তা রক্ষা করা কঠিন।

আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় প্রায় ৭০ কিলোমিটার রেলপথে আছে ১৫টি রেলস্টেশন। তার মধ্যে দুটি বন্ধ রয়েছে। এসব স্টেশনের মধ্যে আখাউড়া রেল জংশনসহ বেশ কয়েকটির আধুনিকায়ন হয়েছে। তবে সে অনুযায়ী বাড়ানো হয়নি নিরাপত্তা। রেলস্টেশনগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে মূলত রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনী। ওই দুটি সংস্থায় রয়েছে লোকবলের চরম সংকট। দুটি ফাঁড়ি বাড়ানোর জন্য রেল পুলিশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখেছে। স্টেশনে প্রায়ই ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের বসার জায়গায় শুয়ে থাকে ছিনতাইকারী, চোর। তারা যাত্রীর কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও টাকা নিয়ে যায়। স্থানীয়দের উদ্যোগে গড়ে তোলা ঐক্যবদ্ধ আখাউড়া  ও ঐক্যবদ্ধ আশুগঞ্জ-এর সদস্যরা সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে মেঘনা সেতু ও এর আশপাশ এলাকা থেকে আটক
করেছে। জেলায় আখাউড়া রেলস্টেশনটি সবচেয়ে বড়। আধুনিকায়নের পর এটির পরিধি আরো বেড়েছে। আর এতেই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। সন্ধ্যার পর স্টেশনের একটি অংশে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। নিয়মিত চুরি হয় রেলওয়ের পণ্য।

এ ছাড়া যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার সময় চোর, ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন ও এর আশপাশে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ। আখাউড়া রেলওয়ে থানার ওসি এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকার দিকে আশুগঞ্জ, চট্টগ্রামের দিকে মন্দবাগ ও সিলেটের দিকে মুকুন্দপুর অংশ আমাদের দেখতে হয়। যাত্রীসেবায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। তবে আমাদের লোকবলের ঘাটতি রয়েছে। ফোর্স বাড়ানোর জন্য চিঠি লেখা হয়েছে। এ ছাড়া কসবা ও আজমপুর স্টেশনে দুটি পুলিশ ফাঁড়ি করার জন্য আবেদন করা হয়েছে।