Image description

গুরুতর অসুস্থ ও লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য জামালপুর থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কারসাজি করা চক্র সুযোগ বুঝে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ভোলায়ও এমন চক্রের কাছে জিম্মি রোগী এবং তাদের স্বজনরা।

 

 

আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :

জামালপুর : গত বৃহস্পতিবার দুপুরে জামালপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের প্রধান গেটের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৩০টি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। পাশে রয়েছেন চালকরাও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামালপুর থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেতে যেখানে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে নির্ধারিত ভাড়া এক হাজার ২০০ টাকা, সেখানে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলো নিচ্ছে তিন-চার হাজার টাকা। শুধু তা-ই নয়, মাঝপথে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট হয়েছে বলে রোগীর স্বজনদের ভয় দেখিয়ে আরেকটি গাড়িতে উঠিয়ে তারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে।

জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের প্রশাসনিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ১০ টাকা। জামালপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত সরকারি ভাড়া এক হাজার ২০০ টাকা এবং ঢাকা মেডিক্যাল পর্যন্ত তিন হাজার ৬০০ টাকা।

সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সংকটের কারণে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়ছে বলে জানায় রোগীর স্বজনরা। তারা বলছে, ‘সরকারি অ্যাম্বুলেন্স থাকলে এত বেশি ভাড়া গুনতে হতো না।

সিদ্দিক নামের একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক বলেন, ‘ময়মনসিংহ পর্যন্ত সাধারণত আমরা তিন হাজার টাকা নিয়ে থাকি। কেউ কেউ চার হাজার টাকাও নেয়। জামালপুর শহরের ভেতরে ভাড়া এক হাজার টাকা। সিন্ডিকেট আছে, তবে অন্যান্য জেলার মতো বড় আকারে নয়।’

জামালপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের নির্ধারিত ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ১০ টাকা।

বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতাল গেটের সামনেই সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। আমরা চেষ্টা করেছি সরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলো আলাদা রাখার জন্য, তবে তা সম্ভব হয়নি।’

ভোলা : ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার জয়া এলাকার দিনমজুর মো. কবির হোসেন। তাঁর মা বার্ধক্যজনিত রোগে ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। গত বুধবার সকালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেন। মাকে বাড়িতে নিতে নানা ঝামেলার পর একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সচালকের সঙ্গে দুই হাজার টাকায় ভাড়া ঠিক করেন। পরে দুপুর ১টার দিকে ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে বোরহানউদ্দিন নিয়ে যান।

এ ব্যাপারে চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সচালক মো. জসিম উদ্দিনের ভাষ্য, তিনি প্রথমে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে দুই হাজার টাকায় ভাড়া ঠিক করেছিলেন। পরে স্থানীয় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সচালকরা বাধা দিলে ঝামেলা এড়াতে তিনি আর যাননি।

ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের সামনে রোগীর সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এমন ঘটনা প্রতিদিনের। অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও মালিকরা কারসাজি করে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, রোগীর স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে এসব অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে দেখা গেছে, রোগী পরিবহনের জন্য ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডের মধ্যে ২০টির বেশি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এর মধ্যে হাসপাতালের সরকারি তিনটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলোই রোগী নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকরা রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে তাঁদের অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে বাধ্য করছেন। এমনকি নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়াও। অন্য কোনো উপজেলা থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্স রোগী বহন করতে চাইলে বাধা দেন স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকরা।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজন কামরুল ইসলামের ভাষ্য, তাঁর এক আত্মীয় সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলে তাঁকে ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। পরে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল নিতে বলেন চিকিৎসক। তিনি প্রথমে হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স খোঁজ করেন। কিন্তু হাসপাতালের সামনে থাকা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা তাঁকে জানান, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও এখন চালক পাওয়া যাবে না। পরে তিনি বাধ্য হয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে করে এক হাজার ২০০ টাকা দিয়ে ভোলার ভেদুরিয়া লঞ্চঘাটে নিয়ে যান। অথচ সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে সেই ভাড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা।

আরেক ভুক্তভোগী মো. আলমগীর অভিযোগ করেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এক স্বজনকে হাসপাতালে নিয়ে এলে ঢাকায় নিতে বলেন চিকিৎসকরা। তখন বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকরা সিন্ডিকেট করে ১৭ হাজার টাকা ভাড়া দাবি করেন।

ভোলা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি মো. মিলন হাওলাদার সিন্ডিকেটের কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘অন্য উপজেলায় আমাদের অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে গেলে আসার সময় সেখানকার অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকরা সেখান থেকে রোগী আনতে দেন না। তাই আমরাও তাঁদের সদর হাসপাতাল থেকে রোগী নিতে দিই না। তবে রোগী নিয়ে তাঁরা এখানে আসতে পারেন।’

ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ আবু সুফিয়ান রুস্তম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাসপাতালের ভেতরে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের দৌরাত্ম্য কমাতে গেট করতে চেয়েছি। এ বিষয়ে আমরা ডিসি অফিস থেকে প্রশাসনিক সহায়তা চেয়েও পাইনি। এখন উল্টো তারা সিন্ডিকেট করে রোগীদের ওপর চাপ তৈরি করে।’ ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান কালের কণ্ঠকে জানান, ‘অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কখনোই আমাদের অবগত করেনি এবং লিখিত আবেদনও করেনি। তারা লিখিতভাবে আবেদন করলে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে রোগী পরিবহনে ব্যক্তি মালিকানধীন ৫৫টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে একটি চক্র আগের মতো সক্রিয়। অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে চলতে হয় ‘সিরিয়াল’ মেনে। এতে রোগী ও তাদের স্বজনদের অতিরিক্ত ভাড়া গোনার পাশাপাশি নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৫০ শয্যা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালে মাত্র দুটি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এর মধ্যে একটি ‘বিকল’। ওই হাসপাতালসহ আশপাশের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী বহনে বেসরকারি মালিকানাধীন ৪৭টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজ ঘিরে রয়েছে আটটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। উপজেলা পর্যায়ে গিয়েও এসব অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে আসে।

অলিখিত নিয়ম অনুসারে, সদর হাসপাতাল বা এর আশপাশ থেকে কোনো রোগীকে কোথাও নিয়ে যেতে হলে স্বজনরা নিজের পছন্দ অনুযায়ী অ্যাম্বুলেন্স নিতে পারবে না। সিরিয়াল অনুযায়ী যে অ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার কথা, সেটা নিয়েই যেতে হবে। ভাড়াও যা দাবি করা হয়, সেটাই দিতে হয়। অ্যাম্বুলেন্সগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার সরাসরি অ্যাম্বুলেন্স নয়। যাত্রী পরিবহনের গাড়িকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মালিক জানান, অ্যাম্বুলেন্সের সিন্ডিকেট আগে থেকেই ছিল। এ নিয়ে কিছুদিন পর পর ঝামেলা হতো। নির্বাচনের মাধ্যমে মালিক সমিতি হলেও এটি কার্যত অচল। একটি পক্ষ সিরিয়াল ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালায়।

২৫০ শয্যা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রতন কুমার ঢালী বলেন, ‘আমাদের দুটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি চালু আছে। প্রয়োজন হলে রোগীদের স্বজনরা বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্স নেয়। তবে তাদের কোনো সিন্ডিকেট আছে কি না তা জানি না। এসব অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের বাইরে থাকে।’

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন রকিব হাসান নয়ন, জামালপুর প্রতিনিধি, ইকরামুল আলম, ভোলা প্রতিনিধি ও বিশ্বজিৎ পাল বাবু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি]