‘চলমান রাজনৈতিক সংকট সরকারের সৃষ্টি, তাই সমাধানও সরকারকে করতে হবে। সরকার মিথ্যা বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। যেটা কোনভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। শুরু থেকেই বিএনপি বর্তমান সরকারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে’
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন উত্তাপ ছড়াচ্ছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট কখন হবে তা নিয়ে। বিশেষ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের কাছে সুপারিশমালা পেশ করার পর বিভক্ত হয়ে পড়েছে ফ্যাসিবাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপির অভিযোগ, দলটির স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে যেসব বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছিল সুপারিশমালায় সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। সনদে স্বাক্ষর হওয়ার পর নতুন এমন কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, যা কমিশনের সভায় আলোচনাও হয়নি। বিএনপি বরাবরই সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে। গণভোটও চায়, তবে সেটি হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন। অন্যদিকে জামায়াত ইসলামীসহ কয়েকটি দল চলতি নভেম্বরেই গণভোট চায়। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দু’টি বড় রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে তৈরি হয়েছে সংকট। ছোট ছোট দলগুলো এ নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। পরিস্থিতি উত্তরণে রাজপথে কর্মসূচি এড়িয়ে কৌশলে পা বাড়াচ্ছে বিএনপি। দলটি মনে করে, বর্তমানে সৃষ্ট জটিলতার দায় সরাসরি অন্তর্বর্তী সরকারের, তাই সমাধানও সরকারকেই করতে হবে।
বিএনপির হাইকমান্ড সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সার্বিক পরিস্থতি মোকাবেলায় ধৈর্য্য ধারণের নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনেও একই কথা জানান, দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের প্রতারণার বিরুদ্ধে আমরা আপাতত রাজপথে কোনও কর্মসূচি দিচ্ছি না। তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। যার সুবিধা নিতে পারে একটি বিশেষ মহল। আমরা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান চাই।
রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে (১ নভেম্বর) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানেও বিএনপির মহাসচিব বলেন, সরকারের প্রতারণার বিরুদ্ধে আমরা রাজপথে দাঁড়াইনি, যমুনাও ঘেরাও করতে যায়নি। আমরা কোনও বিশৃংখলা চাই না, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। তিনি অভিযোগ করে বলেন, চলমান রাজনৈতিক সংকট সরকারের সৃষ্টি, তাই সমাধানও সরকারকে করতে হবে। সরকার মিথ্যা বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। যেটা কোনভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। শুরু থেকেই বিএনপি বর্তমান সরকারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে।
তাছাড়া নির্বাচনের আগে কোনো গণভোট হবে না বলেও সরকারের প্রতি স্পষ্ট বার্তা দেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, বিএনপির দাবি গণভোট সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন হতে হবে। জামায়াত নভেম্বরে গণভোট চাচ্ছে কারণ, তারা জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করতে চায়। তারা সবসময়ই চেয়েছে দেশে যাতে কোন নির্বাচন না হয়। দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে যাক এটাও তারা চায় না। তিনি বলেন, সুপারিশ করলেই সেটা সিদ্ধান্ত হয়ে যায় না। আশা করছি, প্রধান উপদেষ্টা দেশের জনগণের কথা ভেবে সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন।
সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ ও গণভোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বেশিরভাগ উপদেষ্টা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের পক্ষে। তাছাড়া বৈঠকে জুলাই সনদের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের আইনগত কিছু জটিলতার কথাও প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, সমস্যা নিরসনে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েক উপদেষ্টা।
সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি যদি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নেয় তাহলে জামায়াত নভেম্বরেই গণভোটের দাবি থেকে সরে আসতে পারে। অন্যদিকে গণভোট কখন হবে, এটা নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থান এখন কিছুটা নমনীয়। দলটির একাধিক সূত্র বলছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হলেও তারা মেনে নেবে। আবার জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার ক্ষেত্রেও তাদের আপত্তি নেই। এ ব্যাপারে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, গণভোটের সময় নিয়ে এনসিপি অনমনীয় নয়, তবে সেটা জাতীয় নির্বাচনের আগে হলে ভালো হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ জানান, বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। এমন একটি সংসদ প্রয়োজন, যারা গণতন্ত্রকে বাস্তবায়ন করবে। বিএনপি সবসময় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষেই ছিল, এখনো আছে। এজন্যই আমরা সনদে স্বাক্ষর করেছি।
হাফিজ বলেন, যেসব ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, তা নিয়ে সনদ হওয়ার কথা। সুষ্ঠু নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় যাবে, তারাই সনদ বাস্তবায়ন সম্পন্ন করবেন। এখন প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন। তিনি বলেন, নির্বাচন হওয়ার স্বার্থে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিএনপি অনেক কিছু মেনে নিয়েছে। তারপরও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই মূহূর্তে কোনো ধরণের কর্মসূচি থেকে আমরা বিরত আছি।
শীর্ষনিউজ