Image description

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। বিশেষ করে ধাপে ধাপে সংসদ সদস্য প্রার্থী বাছাই করছে দলটির হাইকমান্ড। কেননা, প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াকে সুদূরপ্রসারী ও বহু স্তরের কাঠামোর মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে দলটি। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী প্রার্থী তালিকা তৈরিতে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। ত্রুটিমুক্ত ও শক্তিশালী প্রার্থী তালিকা প্রণয়নের জন্য চলমান এই প্রক্রিয়া ছয়টি ধাপে সম্পন্ন হবে। প্রতিটি ধাপের গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রার্থী বাছাইয়ের মাঝপথে রয়েছে বিএনপি। বর্তমানে দলটির প্রার্থী বাছাইয়ে তৃতীয় ধাপ পুরোদমে চলছে। এই ধাপে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রসহ (এনআইডি) বিস্তারিত তথ্য নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

গত মঙ্গলবার ছবি ও আইডি কার্ড জমা দেওয়ার নির্ধারিত সময় থাকলেও নানা কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। দু-এক দিনের মধ্যেই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে। এই তথ্যাবলি চূড়ান্ত বাছাইয়ের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, যা তাদের পরিচয় ও বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাইয়ে সহায়ক হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বিএনপির গুলশান কার্যালয়, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এরই মধ্যে প্রথম ধাপে নিজস্ব সূত্র দিয়ে জরিপ করিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দ্বিতীয় ধাপে দলের মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডেকে কথা বলার জন্য। তারা এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। বিএনপির প্রার্থী বাছাইয়ের চতুর্থ ধাপ তথা দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হবে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর। এরপর প্রার্থীদের জমা দেওয়া আবেদন যাচাই শেষে বিএনপির নির্বাচনী মনোনয়ন বোর্ডে নেওয়া হবে সাক্ষাৎকার। তারপর ষষ্ঠ বা শেষ ধাপে চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করে তাদের প্রত্যয়নপত্র বা চিঠি দেওয়া হবে। এবারের নির্বাচনে বিশেষত তরুণ এবং তৃণমূলে জনসম্পৃক্ততা, সাংগঠনিকভাবে দক্ষ এবং জনগণের কাছে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা আলাপকালে কালবেলাকে জানান, নির্বাচনী তপশিলের আগেই বিএনপি দলীয় প্রার্থীদের সবুজ সংকেত দিলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরও সক্রিয় হবে এবং কিছু সংকট দেখা দেবে। তা ছাড়া যে আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন সেখানে প্রার্থীকে এখনই নির্দিষ্ট করা হলে মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি কমবে, যা দলের আয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। তারা বলেন, বিএনপি হচ্ছে সত্যিকারের একটি জনপ্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল। জনগণ তথা জনসমর্থনই এই দলের মূল ভিত্তি। নির্বাচনের সময় দলীয় মনোনয়ন বিক্রির ঘোষণা দিলে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ নিজ অনুসারীদের নিয়ে দলবেঁধে দলীয় মনোনয়ন ফর্ম কিনতে আসেন। একই আসনে তিন থেকে সাত-আটজনেরও বেশি ব্যক্তি মনোনয়ন ফর্ম কেনেন। এতে দলের একটি বিরাট অংকের আয় হয়। সুতরাং নির্বাচনী তপশিলের আগেই প্রার্থীকে ‘সবুজ সংকেত’ দিলে কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুল মঈন খান গতকাল বুধবার কালবেলাকে বলেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আমরা চেষ্টা করছি অক্টোবরের মধ্যেই একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করার। তবে বিষয়টি সরাসরি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তদারকি করছেন। তিনি বলেন, এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সরাসরি কথা বলেছেন। এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে সবাইকে দলের সিদ্ধান্ত মেনে চলার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। নির্বাচনী তপশিলের আগেই প্রার্থী চূড়ান্ত করলে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রিতে কোনো প্রভাব কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মঈন খান বলেন, আমরা তো কাউকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দিচ্ছি না। সুতরাং সেজন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। অক্টোবর মাস তো এখনো শেষ হয়নি।

বিএনপির কুমিল্লা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া গতকাল বুধবার কালবেলাকে বলেন, তার বিভাগের ২২টি সংসদীয় আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রায় সবার কাছ থেকে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও একটি করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি নেওয়া হয়েছে। সেগুলো দলীয় কার্যালয়ে জমা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমন কিছু আসন আছে, যেখানে সম্ভাব্য প্রার্থীর সংখ্যা অনেক।

জানা যায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই এরই মধ্যে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এরই মধ্যে অনেক প্রার্থী (সম্ভাব্য দুইশ আসন) দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি ফোনকল পেয়ে নির্বাচনী প্রস্তুতি ও মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছেন। বিষয়টিকে মনোনয়নের ‘সবুজ সংকেত’ হিসেবেই দেখছেন তারা। যারা ফোন পেয়েছেন, তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এই প্রক্রিয়াকে চূড়ান্ত মনোনয়ন হিসেবে দেখছেন না। বরং প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াকে ‘নির্বাচনপূর্ব প্রাক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। অতীতের মতো শুধু মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নয়, এবার একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যোগ্যতম নেতাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে বিএনপি।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দুই ধাপ শেষ করেছে বিএনপি। প্রথম ধাপে গত কয়েক মাসে নিজস্ব বিশ্বস্ত সূত্রে সারা দেশে নির্বাচনী আসনে জরিপ চালিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দ্বিতীয় ধাপে দলের মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে ডেকে কথা বলার দায়িত্ব দেন, যা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। মূলত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসন এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। যেসব আসনে একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছেন বা অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিদ্যমান সেসব আসনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সিনিয়র নেতারা বিভাগীয় ও আঞ্চলিক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কাজ করছেন। দলীয় সূত্র বলছে, বরিশাল, কুমিল্লা, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আসনে অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। এমন আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে চলার বিষয়ে প্রার্থীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে।

বিএনপির রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিন শওকত বুধবার কালবেলাকে বলেন, তার বিভাগের সংসদীয় আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে তাদের একটি করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি জমা নেওয়া হচ্ছে। শিগগির তিনি সেগুলো কেন্দ্রে জমা দেবেন। এর মধ্য দিয়ে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া আরও একধাপ অগ্রসর হলো বলে তিনি মনে করেন।

জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এরই মধ্যে প্রাথমিক জরিপ ও তথ্য সংগ্রহ সম্পন্ন করেছেন। এ ধাপে একাধিক জরিপের মাধ্যমে প্রতিটি আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর জনসমর্থন, এলাকার সমস্যা সমাধানে তাদের ভূমিকা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়তা মূল্যায়ন করা হয়। একই সঙ্গে দলীয় কর্মকাণ্ডে ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ধাপে দলের সিনিয়র নেতারা অঞ্চলভিত্তিক কোন্দলপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সম্পর্কে স্থানীয় নেতাদের মতামত সংগ্রহ করা হয়, যা ছিল প্রথম ধাপের জরিপ তথ্যের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার সমন্বয়। তৃতীয় ধাপে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যক্তিগত নথিপত্র (আইডি কার্ড, ছবি ইত্যাদি) সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো—একাধিক প্রার্থীর উপস্থিতিতে দলীয় ঐক্য নিশ্চিত করা। চতুর্থ ধাপে দলীয় মনোনয়নপত্র বিক্রি ও জমাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। পঞ্চম ধাপে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা বাছাইকৃত সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভার্চুয়াল বা সশরীরে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবেন। এ সাক্ষাৎকারে প্রার্থীর অতীত কর্মজীবন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং দলের ৩১ দফা রূপরেখা সম্পর্কে তার ধারণা মূল্যায়ন করা হবে। পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টনের বিষয়টিও বিবেচনাও নেওয়া হবে। যাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুযোগ নিতে না পারে। এরপর ষষ্ঠ ধাপে ৩০০ আসনের জন্য দলের এবং জোটের মনোনীত একক ও চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে।

জানা গেছে, অক্টোবরের মধ্যেই ৭০ শতাংশ আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করার লক্ষ্য রয়েছে বিএনপির। এ বাছাই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো—তরুণ নেতৃত্বের ওপর গুরুত্বারোপ। বিএনপি মনে করে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, তাতে তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো জরুরি। এ কারণেই দলের হাইকমান্ড শতাধিক আসনে নতুন মুখ আনার পরিকল্পনা করছে। প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণে এলাকার জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক শক্তি এবং জনগণের সঙ্গে প্রার্থীর নিবিড় সম্পৃক্ততাকে প্রধান মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য বদরুল আলম চৌধুরী শিপলু কালবেলাকে বলেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে বিএনপি এবার অভিজ্ঞ ও নবীনের একটি ভারসাম্যমূলক সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, প্রার্থী বাছাই করা হবে দলের ভেতরে গ্রহণযোগ্যতা ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিচারে, যা নতুন নেতৃত্বের জন্য সুযোগ তৈরি করবে বলে আমি মনে করি।

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, দলের নীতিনির্ধারকরা আশা করছেন, বহু-স্তরীয় এ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন একটি তালিকা তৈরি করতে যা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং দলীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠবে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভালো ফল করার জন্য এ সুচিন্তিত প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াকে বিএনপির একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবেও বলতে পারেন। তবে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বিষয়ে বিস্তারিত জানেন সাংগঠনিক সম্পাদকরা।