
জুলাই সনদকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে যে ত্রিমুখী বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা নতুন এক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে গড়ে ওঠা সংস্কারপন্থি ঐক্যের চিত্র যেন হঠাৎ করেই পাল্টে গেছে।
জন্মলগ্ন থেকেই জামায়াতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এনসিপি এখন জামায়াত ও বিএনপি—দুই দলেরই কঠোর সমালোচনা করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই সনদের স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যে ঐক্যের ঘোষণা এসেছিল, তা আসলে রাজনৈতিক বাস্তবতার জটিল ছায়াতেই জন্ম নিয়েছিল। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে, গণভোট কখন হবে, ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন কী হবে—এই তিন বিষয়ে রাজনৈতিক মতপার্থক্য কাটেনি। বিশেষ করে সনদের বাস্তবায়ন কাঠামো ও সময়সীমা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, সেটিই পরবর্তীতে আস্থার সংকটে রূপ নেয়। সনদ চূড়ান্ত হওয়ার পরই সেটি প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে রূপ নেয়, যা এখন ‘সংস্কারপন্থি ঐক্য’র ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
এনসিপি-জামায়াত ‘বন্ধুত্বে’ ভাঙন
জন্মলগ্ন থেকেই জামায়াতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর হঠাৎ করেই জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান নিয়েছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে জামায়াতের চলমান আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক প্রতারণা’ আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলো জাতির গণঅভ্যুত্থানের চেতনা থেকে সংস্কার আলোচনাকে সরিয়ে নেওয়া। এই মন্তব্য রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
জুলাই সনদ নিয়ে শুরু থেকেই বিএনপি, এনসিপি এবং জামায়াত ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে ছিল। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকগুলোতে এই মতভিন্নতা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। দীর্ঘ আট মাসের সংলাপের পর রাষ্ট্র সংস্কারে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর মতপার্থক্যের কারণে শেষ মুহূর্তে সনদ স্বাক্ষরে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতসহ ২৫টি দল সনদে স্বাক্ষর করলেও এনসিপি তা থেকে সরে দাঁড়ায়। নাহিদ ইসলাম দাবি করেন, “সনদ বাস্তবায়নের আগে আইনি ভিত্তি নির্ধারণ না করে এতে স্বাক্ষর করা কেবল জনপ্রিয়তার রাজনীতি। ”
এদিকে, সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত না করলে স্বাক্ষর না করার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এই সনদে স্বাক্ষর করেন। ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় যে, জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও এর আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা না পেলে দলটি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া এবং নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট সম্পন্ন করার শর্ত মৌখিকভাবে উপস্থাপন করে জামায়াতে ইসলামী সনদে স্বাক্ষর করেছে বলে জানায় দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাহবুব জুবায়ের বাংলানিউজকে বলেছেন, “৫ আগস্ট বিপ্লবের পর জুলাই সনদ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জাতীয় কুমার কমিশনের দীর্ঘদিনের আলোচনার পর এটি স্বাক্ষরিত হওয়ায় দেশের ইতিহাসে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে থাকবে। তবে জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোটের দাবিতে কর্মসূচি পালন করছে। আমরা আশা করি এই দাবি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ”
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামায়াতের এই শেষ মুহূর্তের স্বাক্ষর করাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বা ‘প্রতারণা’ হিসেবে দেখছে এনসিপি। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এনসিপি শুরু থেকেই চাইছিল জামায়াত যেন সনদে স্বাক্ষর না করে। সনদে স্বাক্ষরের আগের দিন এনসিপির শীর্ষ নেতারা জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদের সঙ্গে দেখা করে এমন অনুরোধও জানিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জামায়াত সনদে স্বাক্ষর করায় গত এক বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘সুসম্পর্কে’ থাকা দল দুটির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
এর রেশ ধরেই জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দুইদিন পর গত ১৯ অক্টোবর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ফেসবুক পোস্ট করেন। এতে তিনি লিখেছেন, “জামায়াতে ইসলামীর কথিত ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) আন্দোলন’ একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। ঐকমত্য কমিশনের সংস্কারপ্রক্রিয়া এবং জাতীয় সংলাপকে গণ–অভ্যুত্থানের আলোকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রকৃত প্রশ্ন থেকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে এটা (পিআর আন্দোলন) তোলা হয়েছে। ”
জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর ছুড়ে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, “সংবিধানের একটি সুরক্ষা হিসেবেই ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি মৌলিক সংস্কারের অন্যতম দাবি ছিল। আমরা এ ধরনের মৌলিক সংস্কার এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো তৈরি করার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জামায়াত এবং তার সহযোগীরা এটা ছিনতাই করেছে, তারা একে একটি কাঠামোগত পিআর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে এবং এটাকে তাদের ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দর–কষাকষির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ”
এনসিপির শীর্ষ নেতাদের কেউ এর আগে প্রকাশ্যে জামায়াতের তীব্র সমালোচনা করেননি। জামায়াত নিয়ে হঠাৎ নাহিদের এমন পোস্টের কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতকে ‘বন্ধু’ ভেবেছিল এনসিপি। বিশেষ করে সংস্কার ও বিচারের প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য ছিল। কিন্তু জুলাই সনদে স্বাক্ষর করাসহ জামায়াতের সাম্প্রতিক বিভিন্ন কার্যক্রমে এনসিপির মধ্যে এক ধরনের ‘বিশ্বাসভঙ্গের বোধ’ তৈরি হয়েছে। সে কারণেই জামায়াতের ‘রাজনৈতিক দ্বিচারিতার’ বিষয়টি এখন জনসমক্ষে নিয়ে আসতে চাইছেন এনসিপির নেতারা। পিআর পদ্ধতিসহ পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াতের নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলছে, সেখানে এনসিপিকেও রাখার চেষ্টা চলছিল, তবে কিছু দাবির সঙ্গে একমত না হওয়ায় এনসিপি শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনে যুক্ত হয়নি।
এনসিপি ও বিএনপির নতুন বিরোধ, ‘জুলাই যোদ্ধা’ বিতর্ক
অন্যদিকে শুরু থেকেই বিএনপির সঙ্গে দূরত্বে থাকা এনসিপির বিরোধ আবারও প্রকাশ্যে এসেছে। জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিন অনুষ্ঠানস্থলে ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ বিক্ষোভ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের এক মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ১৮ অক্টোবর দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমাধীস্থলে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে আগের দিন ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ ঘটনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, “এখানে জুলাইযোদ্ধাদের নামে কিছু ছাত্র নামধারী উচ্ছৃঙ্খল লোক ছিল, যাদের আমি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অনুসারী মনে করি। ”
এর প্রতিক্রিয়ায় নাহিদ ইসলাম বলেন, “সংসদ ভবনের সামনে আহত জুলাইযোদ্ধাদের ফ্যাসিস্ট অনুসারী বলা কেবল অসম্মান নয়, এটি শহীদ পরিবারের প্রতি অশ্রদ্ধা। সালাহউদ্দিন আহমদকে অবিলম্বে এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে হবে। ” নাহিদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ২০ অক্টোবর দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে সালাহউদ্দিন আহমদ নাহিদের এই ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানকে স্বাগত জানান।
তবে তিনি একইসঙ্গে জানান যে তার বক্তব্য আংশিক প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “জুলাই যোদ্ধাদের ফ্যাসিবাদের দোসর বলে আমার যে বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে, সেটি কাটছাঁট করে আংশিকভাবে প্রচার করা হয়েছে। বক্তব্য কাটিং করে প্রচার না করতে সকলের প্রতি আহ্বান জানাই। আমার বক্তব্যের মাধ্যমে জুলাই যোদ্ধাদের সম্মানিত করার চেষ্টা করেছি। ঐক্যের মধ্যে কলঙ্কের দাগ লাগুক তা আমরা চাই না। তাই বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। ” তবে সালাহউদ্দিন আহমদ এও জানান যে, বিএনপিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপরীতে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চলছে। তিনি এই অপপ্রয়াস সফল হবে না বলেও সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনার মধ্য দিয়েই বিএনপি ও এনসিপির সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রকাশ্যে চলে আসে। যদিও বিএনপি এবং এনসিপির নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন বাকযুদ্ধ শুরু থেকে দৃশ্যমান ছিল, তবে জুলাই সনদকে ঘিরে তা আবারও জটিল রূপ ধারণ করছে।
নাহিদের বক্তব্যে জামায়াতের প্রতিক্রিয়া ও এনসিপির অবস্থান
অন্যদিকে, জামায়াতকে নিয়ে নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। ১৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে এহসানুল মাহবুব জুবায়ের সাংবাদিকদের বলেন, “দায়িত্বশীল জায়গা থেকে নাহিদ ইসলামের পিআর নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন ইস্যুতে এ ধরনের বক্তব্য অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য। যা কোনোভাবে সমর্থন করে না জামায়াতে ইসলামী। ”
দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক গোলাম পরওয়ারও নাহিদের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে ২০ অক্টোবর সাতক্ষীরার তালায় অনুষ্ঠিত ছাত্র-যুব সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় এনসিপিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “বড় বড় রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক ভাষায় সমালোচনা করো। কিন্তু অশালীন, অশোভন ও অরাজনৈতিক ভাষা ব্যবহার করাটা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের শোভনীয় নয়। তোমরা নতুন ছাত্রদের দল। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে তোমাদের আরও বহুদূর যেতে হবে। জন্ম নিয়েই বাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ো না। ”
এনসিপির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে তারা জামায়াতের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বিনিময়ে জামায়াত কোনো সমর্থন দেয়নি। এনসিপির নেতাদের দাবি ছিল—আগামী সংসদকে গণপরিষদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান সংস্কার করা। কিন্তু জামায়াত এই দাবিকে সমর্থন করেনি। তাদের মতে, জামায়াত ও বিএনপি ক্ষমতা ভাগাভাগির পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে গেছে। তারা আইনি ভিত্তিহীন সনদে সই করে সংস্কার আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। এনসিপি আইনি ভিত্তি ছাড়া কোনো সনদ মানে না। তারা একাই সংস্কারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলেও জানান।
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এনসিপির উদ্যোগে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল যুগপৎ আন্দোলনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু আন্দোলন শুরুর আগে এনসিপি ও কয়েকটি দল সরে দাঁড়ায়। তাদের যুক্তি ছিল, জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে আন্দোলনে গেলে তারা ‘ডানপন্থি তকমা’ পাবে। এরপরও জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ সাতটি দল জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে রাস্তায় নামে। এনসিপি এতে অংশ নেয়নি। তাদের মতে, “আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল উচ্চকক্ষ গঠন, কিন্তু জামায়াত আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে পুরো নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করার দাবি তোলে, যা রাজনৈতিকভাবে অবাস্তব। ”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতকে নিয়ে এনসিপির সাম্প্রতিক বক্তব্যের ভাষা স্পষ্টতই আক্রমণাত্মক এবং তা শুধু জামায়াত নয়, বিএনপির প্রতিও বিরাগের ইঙ্গিত বহন করছে। এতে ‘সংস্কারপন্থি’ বলয়ে নতুন বিভাজনের সৃষ্টি হতে পারে, যা ভবিষ্যতের নির্বাচনী সমঝোতাকে আরও জটিল করে তুলবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, “নাহিদ ইসলামের স্ট্যাটাস বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করেছে, যার প্রভাব আগামী রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এনসিপির উচিত হবে জামায়াতের মতো দল থেকে দূরে থাকা। জামায়াত একটি শরিয়া-ভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখালেও বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এতটা কট্টর অবস্থান সমর্থন করে না। ”
ভবিষ্যৎ নির্বাচনী সমঝোতা ও বিভক্ত বাস্তবতা
তবে এসব বাকবিতণ্ডা এবং জুলাই সনদ নিয়ে মতভিন্নতা সত্ত্বেও তিন দলেরই শীর্ষ নেতারা বলছেন, নির্বাচনী সমঝোতা থেকে কেউই সরে যায়নি। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—সবাই ভবিষ্যতের বৃহত্তর রাজনৈতিক মিত্রতার দরজা খোলা রেখেছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, “একেক দলের নেতারা একেক কথা বলবেন। নানাজনে তাদের নানা রকম দাবি জানাবেন। এটাই তো গণতন্ত্র। এর জন্যই তো আমরা এত লড়াই সংগ্রাম করেছি। মতপ্রকাশ করতে পারার স্বাধীনতাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এখানে আমি তো ভিন্ন কিছু দেখি না। ”
এ ধরনের বিরোধ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে কি না জানতে চাইলে বিএনপির এই শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, “এখনো পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল কি বলেছেন তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায় না? সবাই তো ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েই আগাচ্ছেন। কৌশলগত কারণে রাজনীতির মাঠে নানাজনে নানা কথা বলবে। এটা ঠিক আছে বলেই আমি মনে করি। ”
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—বাস্তবতা হলো, জুলাই-আগস্ট ও সংস্কার আন্দোলনের ‘অভ্যন্তরীণ ভাঙন’ এখন প্রকাশ্যে। একসময় যেসব দল একে অপরের পাশে ছিল, আজ তারা মুখোমুখি। জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ বাস্তবায়ন এখন নির্ভর করছে এই বিভাজন মেরামতের ওপর, নাকি এটিই হবে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সূচনা, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে পুরো জাতি।
জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়েই বাস্তবায়ন করবে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছে সেই ৪৭টি সিদ্ধান্ত, সেগুলো বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। পরের ভাগে রয়েছে ৩৭টি সিদ্ধান্ত, সেগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। তবে, এই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেই বিষয়ে আলাদা করে কোনো সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এই অস্পষ্টতা এবং দলগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভেদ জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে।