
হারুনের জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের মিঠামইন। মিঠামইন সবাই চেনে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কারণে। এখান থেকেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। হারুন অর রশীদ মূলত আবদুল হামিদের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠেন। আবদুল হামিদের কারণেই তিনি পুলিশের চাকরি পেয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আড়াল করে আবদুল হামিদই তার পদোন্নতির তদবির করতেন। কিন্তু ক্রমশ আবদুল হামিদকে ছাপিয়ে হারুনই হয়ে ওঠেন মিঠামইনের রাজা। নিরীহ মানুষের জমি দখল করে এখানে গড়েন সম্পদের পাহাড়।
হারুন তার গ্রামের বাড়িতে শতকোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছিলেন প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট নামে অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল একটি প্রমোদাগার। মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে ৪০ একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে রিসোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। রিসোর্টটির প্রিমিয়াম স্যুটের প্রতিদিনের ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন ডিলাক্স রুমের ভাড়া প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া সুপার ডিলাক্স রুমের ভাড়া ১২ হাজার টাকা। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রিসোর্টটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। রিসোর্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং রিসোর্ট উদ্বোধন উভয় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের ছেলে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক।
প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তার ছোট ভাই ডা. শাহরিয়ার। রিসোর্টটিতে হারুনের পরিবারের ৫ থেকে ৭ একর জায়গা রয়েছে। বাকি অন্তত ৩৫ একর জায়গা ছিল অন্যদের। এসব জায়গার মালিকদের দাম দেওয়ার কথা বলে হারুন রিসোর্টের জন্য জায়গা দখলে নেন। জায়গার মালিকদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজন রয়েছেন। এসব জায়গার জন্য কেউই পুরো দাম পাননি। কেউ ১০ লাখের মধ্যে ১ লাখ, কেউ ২০ লাখের মধ্যে ২ লাখ এমন হারে টাকা পেয়েছেন। জায়গার দাম না পাওয়ায় এখনো অন্তত ১০ থেকে ১২ জন তাদের জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি। তাদেরই একজন মিঠামইন সদর ইউনিয়নের গিরীশপুর গ্রামের দিলীপ বণিক। তিনি জানান, হারুন রিসোর্ট করার কথা বলে তার ১ একর ১০ শতাংশ জায়গা নিয়েছেন। জমির কোনো দরদামও নির্ধারণ করা হয়নি। তাকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। অথচ জমির দাম হবে অন্তত ২০ লাখ টাকা। টাকা না পাওয়ায় জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি জানিয়ে দিলীপ বণিক বলেন, আমার মতো এমন অন্তত ১২ জন রয়েছেন, যাদের নামমাত্র টাকা দিয়ে জমি রিসোর্ট করার জন্য হারুন নিয়ে গেছে। আমরা জমির দলিল দেইনি। রিসোর্টের জন্য নেওয়া ১২ আনার মতো জায়গার দলিল হয়েছে, বাকি জমির দলিল হয়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে দিলীপ বণিক বলেন, আমার জমির কাগজ ও দলিল রয়েছে। যেহেতু জমি বিক্রি করিনি তাই আমিই জমির মালিক।
এলাকাবাসী বলছেন, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের আশীর্বাদ এবং সহযোগিতায় চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে পুলিশের বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন হতে পেরেছেন। মো. আবদুল হামিদ সে সময় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় তাকে খুশি করতে দাপুটে পুলিশ অফিসার হারুন তার রিসোর্টের নাম দিয়েছেন ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’। ফলে নিজেদের তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জায়গা না থাকলেও রিসোর্টের জন্য জায়গা নিতে বেগ পেতে হয়নি। রিসোর্টটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় সেখানে মাত্র একটি পুকুর ছিল। এখন চারপাশে গাছপালা, ডুপ্লেক্স কটেজ, কালচারাল সেন্টার, আউটডোরসহ নানা কারুকার্য সংবলিত পাথরের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করা হয়েছে। রয়েছে একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁ, শিশুপার্ক, ওয়াচ টাওয়ার, লেকসহ নানা কিছু। সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদসহ আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী-এমপি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিচার বিভাগের কর্মকর্তা, চলচ্চিত্র জগতের তারকা এবং ভিআইপি ব্যক্তিরা বিলাসবহুল রিসোর্টটিতে সময় কাটিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে রিসোর্টটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে।
৫ আগস্টের পর এই রিসোর্ট নিয়ে তদন্তে নামে এনবিআর। মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের মালিকানাধীন প্রেসিডেন্ট রিসোর্টে অভিযান চালায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল-সিআইসি। অভিযানে রিসোর্টের চারটি কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ও বেশ কিছু নথিপত্র জব্দ করা হয়।
গত বছরের ৯ ডিসেম্বর বিকালে ঢাকা থেকে আসা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি টিম হারুনের বিলাসবহুল এই রিসোর্টে অভিযান চালায়। তারা রিসোর্টের বিভিন্ন কক্ষসহ আশপাশে তল্লাশি চালায়। এনবিআরের পরিচালক চাঁদ সুলতানা চৌধুরানীর নেতৃত্বে অভিযানে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন।
দুপুর সোয়া ২টা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী অভিযানে রিসোর্ট থেকে চারটি কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ও বেশ কিছু নথিপত্র জব্দ করা হয়। সরকারি রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদন্তের অংশ হিসেবে অভিযান চালানো হয়। এ অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা দায়ের করে এনবিআর। এখন এনবিআর এই প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট জব্দ করেছে।