Image description
দুদকের মামলায় নেই বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য

বিতর্কিত স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। বিপুল অর্থ পাচার করে তিনি কলকাতা ও অস্ট্রেলিয়ায় গড়ে তুলেছেন ছয়টি জুয়েলারি শোরুম। সস্ত্রীক দিলীপের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করলেও এসব সম্পদের (বিদেশি বিনিয়োগ) খোঁজ নেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফলে তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলাকে দায়সারা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি অস্বাভাবিক দ্রুততায় সব মামলায় জামিন, অতিগোপনে কারামুক্তি ও দেশত্যাগের খবরে ‘রহস্যময়’ চরিত্র হিসাবে নতুন করে আলোচনায় দিলীপ। এরই ধারাবাহিকতায় যুগান্তরের হাতে এসেছে তার অর্থ পাচার ও বিদেশে সম্পদের ফিরিস্তি। দুদক উদ্যোগ নিলে তা চিহ্নিত করা খুবই সহজ বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তিন দফা দিলীপের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। কিন্তু প্রতিবারই তিনি ক্ষমতার প্রভাবে অভিযোগ নথিভুক্ত করে অব্যাহতি বা ‘ক্লিনচিট’ নেন। তখনো তার এসব সম্পদ দুদকের নজরে আসেনি।

জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ও তার স্ত্রী সবিতা আগরওয়ালার বিরুদ্ধে গত ৮ অক্টোবর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। নতুন কোনো তথ্য থাকলে মামলার তদন্তকালে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। যদি বিদেশে তার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায় তা মামলার অভিযোগপত্রে সংযুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জ্যাঠা (কাকা) পান্না আগরওয়ালার হাত ধরে চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় এসে দুই দশকের ব্যবধানে ধনকুবের বনে যান দিলীপ। ‘রহস্যময়’ চরিত্রের অধিকারী দিলীপের দরবারে ভিড় ছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের। আওয়ামী লীগের বাণিজ্য উপকমিটিতে পদও বাগিয়ে নেন তিনি। ক্ষমতার প্রভাব বলয়ে অপ্রতিরোধ্যভাবে চালিয়ে যান স্বর্ণের চোরাচালান ও ‘নকল’ ডায়মন্ডের জমজমাট কারবার। ২০০৬ সালে গুলশানের ইউনিয়ন টাওয়ারে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের শোরুমে অভিযান চালিয়ে নকল ডায়মন্ড জব্দ করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলা তদন্ত করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ওই মামলা থেকেও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন দিলীপ। এরপর আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে স্বর্ণ ও ডায়মন্ড জগতের অঘোষিত ডন হিসাবে পরিচিতি পান। বসেন বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে। ফুলেফেঁপে ওঠে তার সম্পদ।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, কলকাতায় পাঁচটি ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি জুয়েলারি শোরুম প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। এই বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কলকাতায় তার জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের নাম পান্না ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট এলাকার কামেক স্কয়ারের প্রথমতলায় বিশাল পরিসরে চালু আছে পান্না ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের শোরুম। আরেকটি শোরুম আছে ২৫৩, রবীন্দ্র সরণির তৃতীয়তলায়। মাতৃমঙ্গল হাসপাতালের বিপরীত পাশের ভবনটিতে এই শোরুম চলছে। তৃতীয় শোরুম কলকাতার ৫১, বিবেকানন্দ রোড, বড় বাজার মার্কেটে। চতুর্থ শোরুমের অবস্থান ধর্মতলায়। এটার অবস্থান ফায়ার ব্রিজ সদর দপ্তরসংলগ্ন ৭ই লিন্ডসে স্ট্রিটের ৪ এইচইআর, গ্লোব মলে। আর পঞ্চম শোরুমটির অবস্থান হাওড়া এলাকার ৬২/২ রোজ মেরী লেনের রাঘব প্লাজা মলে। বাংলাদেশের শোরুমের সঙ্গে হুবুহু মিল রেখে ‘ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড’ নামেই একটি শোরুম গড়ে তুলেছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ক্যাম্বেলটাউনে। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ওয়েবসাইটেও এই শোরুম উদ্বোধনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের শোরুম এখন অস্ট্রেলিয়ায়।

জানা গেছে, দিলীপের দাদির নাম পান্না দেবি। আর কাকার নাম পান্না আগরওয়ালা। দাদিকেই তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রেরণা হিসাবে মনে করে। কাকার নামেই প্রথম তাদের পারিবারিক ব্যবসা চালু করা হয়। কুষ্টিয়ার হরিনারায়ণপুরে ছিল তাদের ‘পান্না সিনেমা হল’। পান্না মুভিজ নামে ছিল সিনেমা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। সিনেমা হলে কাজ করা দিলীপ কাকার হাত ধরেই ঢাকায় আসেন। এরপর যেন হাতে পান আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ। গড়ে তোলেন জুয়েলারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড। আর কলকাতায় দাদির নাম উৎসর্গ করে গড়ে তুলেছেন পান্না ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য দিলীপের ভাই পিন্টু কুমার আগরওয়ালা দেখভাল করেন। মূলত অর্থ পাচার, স্বর্ণ ও ডায়মন্ড চোরাচালান নির্বিঘ্ন করতেই এসব শোরুম গড়ে তোলা হয়েছে।

জানা গেছে, শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিদেশে এসব শোরুম গড়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি দুদকের মামলায় বলা হয়েছে, দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ১১২ কোটি ৪৭ লাখ ২৮ হাজার ৪০৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন এবং ৩৪টি ব্যাংক হিসাবে ৭৫৫ কোটি ৩০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬৩ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। তবে এসব সম্পদের তালিকায় বিদেশে বিনিয়োগের কোনো তথ্য নেই।

আর তার স্ত্রী সবিতা আগরওয়ালার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, তিনি ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৭ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন এবং ৮টি ব্যাংক হিসাবে ২১৩ কোটি ২৮ লাখ ৭৩ হাজার ৯২৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েক বছর আগে আলোচিত মডেল পিয়াসা ডিবির হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তখন পিয়াসা ও তার সহযোগী মিশুর মাদক বাণিজ্য ও স্বর্ণ চোলাচালানের নেপথ্যে দিলীপের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু তৎকালীন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের আশীর্বাদে দিলীপ ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। তবে জুলাই বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পর গুলশান থেকে দিলীপকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার বিরুদ্ধে শুধু ঢাকা মহানগরের উত্তরা পূর্ব, গুলশান, ধানমন্ডি, পল্টন ও মিরপুর থানায় সাতটি মামলা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হত্যাসহ ফৌজদারি আইনে তার নামে মামলার সংখ্যা ডজনের বেশি। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যা, আন্দোলনবিরোধী শক্তিকে অর্থের জোগান দেওয়াসহ নানা অভিযোগে এসব মামলা দায়ের করা হয়। অথচ জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দায়িত্ব পাওয়া সরকারের ঘনিষ্ঠরাই দিলীপকে সব মামলায় জামিন ও অতিগোপনে কারামুক্তির ব্যবস্থা করে দেশ থেকে পালানোর সুযোগ করে দেন।

সব মামলায় জামিন নিয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর কঠোর গোপনীয়তায় কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে যান দিলীপ। অজ্ঞাত কারণে এ সময় কোনো ধরনের গোয়েন্দা রিপোর্টও দেওয়া হয়নি। কারাগারে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যরাও মুখ খোলেননি। নীরব ছিল কারা কর্তৃপক্ষও। কারাগার থেকে বেরিয়েই তিনি অবৈধ পথে সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় চলে গেছেন বলে জানা গেছে। সরকারের প্রভাবশালী একজন আইন কর্মকর্তা দিলীপের গোপন মুক্তির নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ওই আইন কর্মকর্তা আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। দিলীপ তার নির্বাচনি খরচ চালাবেন বলে চুক্তি হয়েছে বলে গুঞ্জন আছে।

এসব বিষয়ে জানতে দিলীপ কুমার আগরওয়ালার একাধিক মোবাইল ফোন নম্বরে (হোয়াটসঅ্যাপ) কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে দিলীপের আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আদালত তাকে জামিন দিয়েছেন। যথানিয়মে বেইলবন্ড কারাগারে পৌঁছানোর পর তিনি মুক্ত হন। এক্ষেত্রে অনিয়মের কিছু নেই।’ দেশত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার পাসপোর্ট জব্দ অবস্থায় আছে। ফলে তার বিদেশে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি দেশেই আছেন।’