
দেশের রেলপথে চলবে বৈদ্যুতিক ট্রেন-এ স্বপ্ন বহু বছরের। আগের সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে ট্রেন চালুর। এজন্য উদ্যোগও নিয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা চলমান রেলপথেই বৈদ্যুতিক ট্রেন চালানো সম্ভব, নতুন রেলপথের প্রয়োজন নেই-এমন মত দিলে পিছু হটে। দ্রুত ঝুঁকে পড়ে, উন্নয়নের নামে লুটপাটের প্রকল্পে। ১৫ বছরে রেলে সোয়া লাখ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও এড়িয়ে যায় বৈদ্যুতিক ট্রেন। অথচ পাশের দেশ ভারতে একশ বছর আগে অর্থাৎ ১৯২৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎচালিত ট্র্যাকে ট্রেন চালানো শুরু হয়। বিশ্বের যেসব দেশে ট্রেন চলছে-সবখানেই এখন পুরোদমে চলছে বৈদ্যুতিক ট্রেন। পিছিয়ে শুধু বাংলাদেশ।
যদিও উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের মাধ্যমে বাংলাদেশেও বৈদ্যুতিক ট্রেনের সূচনা হয়েছে, তবে সেটি বিশেষায়িত ট্রেন। বৈদ্যুতিক বন্দোবস্তে সাধারণ ট্রেনের স্বপ্ন এবার পূরণ হতে চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার সাধারণ রেলপথ বৈদ্যুতিক ট্রাকে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে জয়দেবপুর পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ট্রেন চালাতে নকশা চূড়ান্ত করেছে। প্রস্তুত করা হয়েছে বিস্তারিত প্রকল্প নকশা। অর্থায়নের জন্য যোগাযোগ করছে জাপানের প্রতিষ্ঠান জাইকার সঙ্গে।
রেলওয়ে উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, যুগ এখন বৈদ্যুতিক ট্রেনের, বুলেট ট্রেনের। সাশ্রয়ী ও দ্রুতগতির ট্রেন পরিচালনায় এর বিকল্প নেই। দেশে বৈদ্যুতিক ট্রেনের কার্যক্রম শুরু করে দিয়ে যাচ্ছি। নকশাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। শুরুতে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-জয়দেবপুর পথে, এরপর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে, পরে পুরো রেলই ইলেকট্রিক ট্র্যাক হবে। আশা করছি, নির্বাচিত সরকার এসে এ স্বপ্নের পুরোটা বাস্তবায়ন করবে।
সূত্র জানায়, রূপান্তর হলে চলমান রেলপথে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে দৈনিক একশ, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে আরও দুইশ ট্রেন চালানো সম্ভব। এজন্য লাগবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এতে কমবে পরিচালন ব্যয়, আয় বাড়বে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে সময় সাশ্রয় হবে। বর্তমানে ট্রেন পরিচালনায় বছরে লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় পৌনে ৩ হাজার কোটি টাকা। রেলওয়ে পরিকল্পনা, অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর সূত্র জানায়, বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিচালনায় জ্বালানি-ব্যয় দেশের প্রচলিত ট্রেনের চেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ কম। ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে ৫ থেকে ৭ মিনিট পরপর ট্রেন চালানো যাবে। বারবার ইঞ্জিন বদল করতে হবে না। তাছাড়া ডিজেল ইঞ্জিন চলন্ত অবস্থায় মাঝে মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়-বৈদ্যুতিক ট্রেনে এমনটা হবে না। ট্রেনের শিডিউল রক্ষা সহজ হবে। নির্ধারিত স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি বসানোসহ ইলেকট্রিফিকেশনের মাধ্যমে রেলপথে পরিবর্তন আনা হবে। রূপান্তরের পর ঘণ্টায় দুইশ কিলোমিটার পর্যন্ত ট্রেন চালানো সম্ভব হবে।
সূত্র আরও জানায়, ইলেকট্রিক ট্র্যাকে দুই ধরনের ট্রেন চালানো যাবে। একটি হচ্ছে ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ইএমইউ)-যা আমরা মেট্রোরেলে দেখছি। তবে এক্ষেত্রে একটু বড় পরিসরে। দুপাশে ইঞ্জিন থাকবে, যাত্রীবাহী কোচ থাকবে ১০টি। একটি সেটে ৩২০০ যাত্রী চলাচল করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে চলমান ট্রেনের লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন), পাওয়ার কার ও কোচে কিছু পরিবর্তন (বৈদ্যুতিক রূপান্তর) এনে। ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে শুরুতে ‘ইএমইউ’ ট্রেন পরিচালনা করা হবে। প্রতিদিন ১০০ ট্রেন পরিচালনা করা হলে-৩ লাখ ২০ হাজার যাত্রী পরিবহণ করা যাবে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর হয়ে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেলপথ রূপান্তরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ-জয়দেবপুর-চট্টগ্রাম রুটে তিন শতাধিক ট্রেন চালানো সম্ভব হবে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আফজাল হোসেন বলেন, রেলের লোকসান কমিয়ে আনতে বৈদ্যুতিক ট্রেন নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে। যোগাযোগে সময় কম লাগবে, হবে সাশ্রয়। আমরা নকশা চূড়ান্ত করেছি। আশা করছি, দ্রুত অর্থায়নের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। চলমান রেলপথে নারায়ণগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালানো হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত।