
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনভিত্তিক একক প্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে বিএনপি। এরই মধ্যে হাইকমান্ড থেকে ফোনে কল করে কয়েকটি আসনে একক প্রার্থীকে নির্বাচনি গণসংযোগে নামার বার্তা দেওয়া হয়েছে। তারা ভোটের মাঠে নেমে পড়েছেন। চলতি মাসেই অন্তত ২৫০টি আসনে একক প্রার্থীকে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তফশিলের পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নাম ঘোষণা করা হবে। নানা দিক বিবেচনায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির শীর্ষ কয়েক নেতার আসনে কাউকে সবুজ সংকেত দেবে না বিএনপি। পাশাপাশি মিত্র দল ও জোটের কয়েক শীর্ষ নেতার আসনেও একই কৌশল নেবে দলটি।
এদিকে প্রায় প্রতিদিনই দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আসনভিত্তিক সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডাকা হচ্ছে। সেখানে ভোটারদের মন জয়ের পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধ থেকে দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। ত্যাগী নেতা যারা মনোনয়ন পাবেন না, তাদের ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা হবে। তবে দলীয় নিদের্শনা অমান্য করলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসাবে সোমবার মাগুরা, চট্টগ্রাম ও সুনামগঞ্জের কয়েকটি আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের গুলশান কার্যালয়ে ডাকা হয়। তবে ঢাকা বিভাগ বাদে এখন যেসব আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডাকা হচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগেই বিরোধ আছে। মনোনয়ন কেন্দ্র করে বিরোধ মেটানের চেষ্টা চলছে। এর আগে রোববার সিলেট বিভাগের চার জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে মতবিনিময় করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠকে মনোনয়ন, নির্বাচনি প্রস্তুতি, প্রচারণাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেন তিনি। মতবিনিময় সভায় দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, খুব শিগ্গিরই একক প্রার্থীকে সবুজ সংকেত দেওয়া হবে। ঢাকা ছাড়া সব বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ডেকে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ঢাকা বিভাগের আসনভিত্তিক সম্ভাব্য প্রার্থীদেরও ডাকা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘চমক বলতে ইয়াং জেনারেশন এবার আগের চেয়ে আরেকটু বেশি অগ্রাধিকার পাবে। কারণ, তারা অনেক বেশি অ্যাকটিভ। নারীরাও যথেষ্ট অগ্রাধিকার পাবে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এলাকায় সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয় প্রার্থীরাই বিএনপির মনোনয়ন পাবেন। একই আসনে অনেক প্রার্থী থাকতে পারেন। সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি জনগণের কাছে কার অবস্থান ভালো। এলাকায় কে বেশি জনপ্রিয়, সেই খোঁজখবর নিচ্ছি। এজন্য তৃণমূল থেকে শুরু করে অনেকের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। সিনিয়র নেতারা যার যার দায়িত্ব পালন করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুলশান কার্যালয়ে ডাকা অন্তত দশজন সম্ভাব্য প্রার্থী জানিয়েছেন, প্রায় প্রতিটি আসনে ৪ থেকে ৫ জন করে মনোনয়নপ্রত্যাশী আছেন। এর মধ্যে থেকে যাচাই-বাছাই করে ২ থেকে ৩ জন মনোনয়নপ্রত্যাশীকে ডাকা হয়। সভায় বিএনপির মহাসচিব দলীয় একক প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনার জন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নির্দেশনা দেন।
সিলেট বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউছ বলেন, তাদের সঙ্গে বৈঠক বলা হয়েছে একক প্রার্থী দেওয়া হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জনগণকে সন্তুষ্ট এবং ভোটারদের মন জয় করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল গাজীপুর-১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। স্থানীয়রা জানান, বাবুল ক্লিন ইমেজের ও বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগের আমলে প্রায় ১৬ বছর দলীয় নেতাকর্মীরা বিপদে-আপদে সব সময় তাকে পাশে পেয়েছেন। সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল যুগান্তরকে বলেন, বাছাই-পর্ব চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে দলের হাইকমান্ড থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রার্থী সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। শিগ্গিরই দলের হাইকমান্ড থেকে চূড়ান্ত করবে। এতটুকু জানি-দলের একনিষ্ঠ নেতা, যারা বিগত দিনে দলের দুঃসসময়ে পাশে ছিলেন, আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, কোনোভাবেই শত অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্যেও যারা দলের সঙ্গে বেইমানি করেননি, সর্বোপরি ক্লিন ইমেজ, জনসম্পৃক্ততা ও কর্মীবান্ধব নেতাদের বিষয়েই দল বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে, খোঁজখবর নিচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ঠাকুরগাঁও-১), মির্জা আব্বাস (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), ড. আব্দুল মঈন খান (নরসিংদী-২), ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ (ভোলা-৩) বরকতউল্লা বুলু (নোয়াখালী-৩), মো. শাহজাহান (নোয়াখালী-৪), শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি (লক্ষ্মীপুর-৩), মিয়া নুরুউদ্দিন অপু (শরীয়তপুর-৩), আসাদুল হাবিব দুলু (লালমনিরহাট-৩), অনিন্দ্য ইসলাম অমিত (যশোর-৩), রশিদুজ্জামান মিল্লাত (জামালপুর-১), রকিবুল ইসলাম বকুল (খুলনা-৩), ব্যারিস্টার কায়সার কামাল (নেত্রকোনা-১), মাহমুদ হাসান খান (চুয়াডাঙ্গা-২), ফজলুল হক মিলন (গাজীপুর-৫), আমিরুল ইসলাম খান আলীম (সিরাজগঞ্জ-৫), আমিনুল হক (ঢাকা-১৬), লুৎফুজ্জামান বাবর (নেত্রকোনা-৪), ব্যারিস্টার মুহম্মদ নওশাদ জমির (পঞ্চগড়-১), সাইফুল ইসলাম ফিরোজ (ঝিনাইদহ-৪)-সহ অন্তত ৬০টি আসন নিয়ে নির্ভার বিএনপি। মূলত এর বাইরে অন্য আসনগুলোয় একক প্রার্থী চূড়ান্ত করছে দলটি।
এদিকে কয়েকটি আসনে ইতোমধ্যে দলের হাইকমান্ড থেকে একক প্রার্থীকে ফোন করে মাঠে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বগুড়ার সাতটি আসনের মধ্যে পাঁচটির সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কথা বলে তাদের ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। ওইসব প্রার্থী হলেন-বগুড়া-১ আসনে সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী রফিকুল ইসলাম, বগুড়া-২ আসনে জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও শিবগঞ্জ উপজেলা সভাপতি মীর শাহে আলম, বগুড়া-৩ আসনে আদমদীঘি উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল মুহিত তালুকদার, বগুড়া-৪ আসনে সাবেক সংসদ-সদস্য ও জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন এবং বগুড়া-৫ আসনে সাবেক সংসদ-সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। বিষয়টি নিশ্চিত করে মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে জানান, ৫টি আসনে একক প্রার্থী হিসাবে ৫ জনকে মাঠে কাজ করার জন্য জানিয়ে দিয়েছেন। বাকি বগুড়া-৬ (সদর) ও বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসন দুটি জিয়া পরিবারের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, সবাইকে আরও বেশি সজাগ থাকতে হবে। সর্বোচ্চ ভূমিকা নিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন। যারা মনেপ্রাণে বিএনপি করেন, তাদের দলের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি।
সিরাজগঞ্জের ৬টি আসনের মধ্যে ৫টির একক প্রার্থীকে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনি মাঠের কাজ আরও জোরদার করতে বলেছেন দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। ধারণা করা হচ্ছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা পেয়ে স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য তাদের এ বার্তা দিয়েছেন। যদিও এখন পর্যন্ত তারা দলের হাইমান্ডের কাছ থেকে সরাসরি কোনো কল পাননি। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা যুগান্তরকে বলেন, তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এবারও নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনি গণসংযোগ করছেন। এছাড়াও সাতক্ষীরার একটি, নাটোরের একটি এবং ঢাকার ৫টি আসনেরও একক প্রার্থীকে মাঠে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে বিএনপি থেকে চূড়ান্ত মনোনয়নে বেশ কয়েকটি আসনে নতুন মুখ দেখা যেতে পারে, যারা স্থানীয়ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়। এরকম আছেন গাইবান্ধা-২ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক সচিব আমিনুল ইসলাম। গাইবান্ধা সদর থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বোয়ালী ইউনিয়নের আহ্বায়ক রেজওয়ানূর বাসিত খান যুগান্তরকে বলেন, আমিনুল ইসলাম ব্যাপক গণসংযোগ করছেন। গাইবান্ধার মরা গাঙে তিনি জোয়ার এনেছেন। সততা, যোগ্যতা, পারিবারিক ঐতিহ্য, অমায়িক ব্যবহার, শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ এবং পশ্চাৎপদ জেলা থেকে উন্নত করার দৃঢ় ঘোষণা তাকে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত করেছে। আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘এ আসনে মানুষ পরিবর্তন চায়। গণসংযোগে মানুষের যে সমর্থন ও ভালোবাসা পাচ্ছি, আমাকে মনোনয়ন দিলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ধানের শীষের বিজয় উপহার দিতে পারব।’
অন্যদিকে প্রার্থী মনোনয়নে তরুণদের আগ্রাধিকার দেবে বিএনপি। প্রায় প্রতিটি আসনেই এবার তরুণ প্রার্থীরা মাঠে রয়েছেন। অনেক আসনে আছেন একাধিক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, জেন-জি ও তারুণ্যের এবার ভোট বেশি। সে বিবেচনায় এবার তরুণ প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। কিছু কিছু আসনে স্থানীয়ভাবে অনেক জনপ্রিয় নেতা রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সেখানে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমনের একদিকে রয়েছে ক্লিন ইমেজ, আবার কর্মীবান্ধবও। এ ধরনের তরুণ নেতাদের প্রার্থী করা হলে ধানের শীষের বিজয় সুনিশ্চিত হবে। তবে প্রার্থী নির্ধারণে যদি ভুল সিদ্ধান্ত হয়, সেক্ষেত্রে ওইসব আসনে প্রার্থীর বিজয় নাও হতে পারে।
মাদারীপুর-১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী শিবচর উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব সোহেল রানা। তরুণ এই নেতা বিএনপির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সচিব। তিনি বলেন, রাষ্ট্র মেরামতের যুগান্তকারী ৩১ দফার আলোকে শিবচর উপজেলার প্রতিটি ভোটারের ঘরে ঘরে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রাষ্ট্রভাবনা তুলে ধরছি। জনগণের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা নিতে চাই।