
ধান-নদী-খালের জেলা বরিশালের ছয় আসনেই ত্রয়োদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে জমজমাট প্রচার শুরু হয়েছে। নির্বাচনী মাঠে বেশি সরব বিএনপি ও জামায়াত। ভোটারদের মন জয় করতে তারা গণসংযোগ চালাচ্ছেন বিভিন্ন কৌশলে। তবে বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত না হলেও জামায়াতে ইসলামী এক্ষেত্রে এগিয়ে। আর প্রার্থিতা চূড়ান্ত না হলেও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অন্যান্য দলের প্রার্থীরাও নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তায় সন্ধার পর থেকে কিছুটা শীত অনুভব হলেও নির্বাচনী এলাকার পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস পাড়ায় বিভিন্ন দলের প্রার্থী নিয়ে আলোচনায় নির্বাচনের মাঠ সরগরম।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হাত ছাড়া হওয়া বরিশালের হারানো দুর্গ ফিরে পেতে বিএনপির সম্ভ্রাব্যপ্রার্থীরা যখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন, ঠিক সেই সময় ছয়টি আসনেই ভাগ বসাতে গত প্রায় ছয় মাস পূর্বে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সম্প্রতি ছয়টি আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসেরও প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া দুটি আসনে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এবং একটি আসনে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া না হলেও এনসিপি এবং গণঅধিকার পরিষদ থেকে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন দলের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলে আসছেন তারা ক্লিন ইমেজের প্রার্থীদের হাতে এবার ধানের শীষ তুলে দেবেন। সেক্ষেত্রে অতীতে বিগত ওয়ান ইলেভেন থেকে শুরু করে বিএনপির চরম দুর্দিনে নেতাকর্মীদের নিয়ে যারা রাজপথে থেকে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন, তাদের মূল্যায়ন করা না হলে ভোটের মাঠে দেখা দিতে পারে বিপত্তি।
তবে বরিশালের ছয়টি আসনেই ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটের মূল লড়াই হতে পারে বিএনপির প্রার্থীদের সঙ্গে ইসলামী অন্যান্য দলের প্রার্থীদের।
বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) ॥ সড়ক পথে বরিশালের প্রবেশদ্বারের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে শুধু গৌরনদী উপজেলায় বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আছেন তিন নেতা। পাশাপাশি এ আসনের আগৈলঝাড়া উপজেলায় রয়েছেন মাত্র একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি হলেন বিগত ওয়ান ইলেভেন থেকে শুরু করে বিএনপির দুর্দিনে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে একাধিকবার হামলা, মামলা ও কারাবরণ করা বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবহান।
গৌরনদী উপজেলার প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন- এই আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) আকন কুদ্দুসুর রহমান ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল।
এ বিভাগে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হচ্ছে বরিশাল-১ আসনের আগৈলঝাড়া উপজেলা। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে এ আসনের সবদলের প্রার্থীদের কাছে তাই এ উপজেলার ভোটাররাই বড় ফ্যাক্টর। যে কারণে ত্রয়োদশ নির্বাচনে আগৈলঝাড়া উপজেলার একমাত্র প্রার্থী হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ইউনিট থেকে শুরু করে সবধর্মের সাধারণ জনতা ক্লিন ইমেজের প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবহানকে সমর্থন দিয়েছেন। এর বাইরে গৌরনদী উপজেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করায় সেখানেও রয়েছে তার বিশাল একটি ভোট ব্যাঙ্ক। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবদুস সোবহান বরিশাল-১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
নির্বাচনে প্রস্তুতির বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবহান জনকণ্ঠকে বলেন, বিগত ওয়ান ইলেভেন থেকে শুরু করে এবং তার পরবর্তী সময়ে আমার নেতা তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির চরম দুর্দিনে শেখ হাসিনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দুই উপজেলার দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে ছিলাম। আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। ছাত্রজীবনে খুব কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দেখেছি। তাঁর আদর্শকে ভালবেসে সরকারি চাকরি ছেড়ে টানা ৪০ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। কোনো কিছু নিতে নয়; বরং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একজন সৈনিক হিসেবে দল ও দেশের জন্য কিছু দিতে মাঠে রয়েছি। শতভাগ বিশ্বাস করছি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমার ত্যাগের মূল্যায়ন করবেন।
এ আসনে প্রায় ছয়মাস পূর্বে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য হাফেজ মাওলানা কামরুল ইসলাম খান দলের মনোনীত প্রার্থী হওয়ায় নিয়মিত তিনি দলীয় কর্মকা-ের পাশাপাশি নেতাকর্মীদের নিয়ে নির্বাচনী মাঠে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন মুহাম্মাদ রাসেল সরদার মেহেদী ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে মুহাম্মদ ফখরুল ইসলামকে।
বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) ॥ এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ বিষয়ক সহসম্পাদক কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপু, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও উজিরপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এস শরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু, সদস্য দুলাল হোসেন, কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক লায়ন আক্তার সেন্টু, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল, কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা কর্নেল (অব.) আনোয়ার হোসেন এবং তিন বারের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ প্রয়াত সৈয়দ শহীদুল হক জামালের ছোট ছেলে ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইফুল হক সাইফ।
অপরদিকে এ আসনে জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাস্টার আবদুল মান্নানকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন ইসলামী যুব আন্দোলন বাংলাদেশের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আলহাজ মাওলানা মুহাম্মাদ নেছার উদ্দীন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন মুহাম্মদ আশিকুর রহমান। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন তরিকুল ইসলাম তারেক।
তাছাড়া এ আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনিচুজ্জামান আনিস। তবে গুঞ্জন রয়েছে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এ আসনে সবচেয়ে বেশি উন্নয়নে অবদান রাখা জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভি নির্বাচনের পূর্বে দেশে ফিরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। আর তিনি (অভি) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে পাল্টে যেতে পারে বর্তমান নির্বাচনী মাঠের হিসেব নিকেশ।
বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) ॥ এখানে ব্যাপক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির হেভিওয়েট প্রার্থীদের। এবারও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। তাদের সঙ্গে মুলাদী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আবদুস সত্তার খান এবং ব্যারিস্টার মনিরুজ্জামান আসাদ নির্বাচনী এলাকায় প্রচার চালাচ্ছেন।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন বরিশাল মহানগর শাখার আমির অধ্যক্ষ জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। এছাড়া এবি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ এ আসনে প্রার্থী হবেন। পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের বরিশাল বিভাগীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা কমিটির সভাপতি উপাধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম প্রার্থী হচ্ছেন। তবে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা হলে প্রার্থীর হিসেব-নিকেশ পাল্টে যাবে। এ আসনে খেলাফত মজলিসের মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন মুহাম্মদ আরিফ হোসেন।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী বেগম সেলিমা রহমান বলেন, সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব। দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষেই নির্বাচন করব। অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, দলের দুর্দিনে হামলা-মামলার শিকার হওয়া নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলার সব পর্যায়ের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমার পক্ষে কাজ করছেন। মনোনয়নের বিষয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী।
জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী অধ্যক্ষ জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বলেন, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। ইতোমধ্যে মুলাদী ও বাবুগঞ্জের সব শ্রেণিপেশার মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছি। ভোটের মাঠে যার প্রমাণ দেওয়া হবে। এবি পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, বাবুগঞ্জ-মুলাদীসহ বরিশালের উন্নয়নে আমি কাজ করছি। মানুষ এখন আর চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, দখলদার ও লুটপাটকারীদের পছন্দ করে না। তাই আমি জনগণের রায় পাওয়ার বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী।
বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ-কাজীরহাট) ॥ সংসদীয় এ আসন বরাবরই বিএনপির ঘাঁটি ছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে হারানো সেই আসন পুনরুদ্ধার করতে মাঠে নেমেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান। অপরদিকে বেশ আগেই মনোনয়ন পাওয়া জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক মাওলানা আবদুল জব্বার রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন চরমোনাই পীরের ভাই দলের সহকারী মহাসচিব মুফতি সৈয়দ এছহাক মুহাম্মাদ আবুল খায়ের। খেলাফত মজলিসের মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন মুহাম্মদ জুবায়ের গালিব।
বরিশাল-৫ (সিটি ও সদর) ॥ বিভাগীয় সদরের এ আসন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, এটি মর্যাদার আসন হিসেবে পরিচিত। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই আসনটি বিএনপির দখলে ছিল। এই আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রপতি এবং হুইপ ছিলেন। তবে ২০১৪-২০২৪ সাল পর্যন্ত বিএনপির হাতছাড়া ছিল আসনটি। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে আসনটি চলে যায় আওয়ামী লীগের ঘরে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আবারও আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে প্রমাণ করতে মাঠে নেমেছেন অর্ধ ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী।
সূত্র মতে, আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত থাকলেও অভ্যুত্থানের পর এখানে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কার্যক্রম বেড়েছে অনেক। দল দুটি থেকে শক্ত প্রার্থীও দেওয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলাল এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মাঠে নেমেছেন। দুইজনই অভিজ্ঞ, আস্থাভাজন এবং শক্তিশালী প্রার্থী। সেক্ষেত্রে বিএনপিতে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল হলে আসনটি চলে যেতে পারে জামায়াতে অথবা ইসলামী আন্দোলনের ঘরে এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক সচেতন মহল।
এই আসনে বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস, তাঁর ছেলে নাসিম বিশ্বাস এবং অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার। তিনি টানা তিনবারসহ চারবার এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সংসদের হুইপও ছিলেন। এ বারেও তিনি এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চাচ্ছেন।
তবে সরোয়ারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন একাধিক নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নেতা জানিয়েছেন-২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর মজিবর রহমান সরোয়ারের ভাইদের বিরুদ্ধে বাসস্ট্যান্ড, টেম্পো স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া সদর আসন এবং মেয়র উভয়পদে মজিবর রহমান সরোয়ারের বছরের পর বছর মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে দলের নেতাকর্মীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
এ আসন থেকে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, এবায়েদুল হক চাঁন, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন, কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (পদ স্থগিত) বিলকিস আক্তার জাহান শিরিন। এর মধ্যে আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, মজিবর রহমান সরোয়ার, মনিরুজ্জামান খান ফারুক এবং আফরোজা খানম নাসরিন রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত কার্যক্রমের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছেন নির্বাচনী প্রচার।
দলের দুর্দিন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে সরব উপস্থিত থেকে দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। পতিত সরকারের সময়ে বরিশালে বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজপথে ভূমিকা রাখতে গিয়ে আবু নাসের হামলার শিকার হয়েছিলেন।
নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ভোটারদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। দলের কাছে মনোনয়ন চেয়েছি; দল যদি আমাকে যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দেয়, তাহলে বিজয়ের মাধ্যমে বরিশাল-৫ আসনটি বিএনপিকে উপহার দেব।
বিএনপির অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, বরিশাল বিএনপির ঘাঁটি এটা সবাই জানেন। এখানে জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থীকেই সমর্থন করবেন ভোটাররা। দল অতীতের সব পর্যালোচনা করে আমাকেই মনোনয়ন দেবেন বলে আমি শতভাগ আশাবাদী।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে তৈরি মনোনয়নপ্রত্যাশী আফরোজা খানম নাসরিনের। একজন নারী হয়েও পতিত আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে সম্মুখভাগে ছিলেন এ নারী নেত্রী। যে কারণে পুলিশি হামলা এবং একাধিক মামলার শিকার হয়েছেন তৃণমূল থেকে উঠে আসা মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন।
সাড়ে চার লাখ ভোটারের এই আসনে ভিন্নতা রয়েছে আলোচনায় থাকা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীর ক্ষেত্রে। ২০১৮ সালের মতো এবারেও এ আসনে দলের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের নাম প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটের দিন মেয়র প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করীম আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছিলেন।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলাল পরিচ্ছন্ন ইমেজের এবং দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা। ইতোমধ্যে তিনি ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে সাধারণ জনগণের মনজয় করেছেন।
মুয়াযযম হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়। আওয়ামী-বিএনপির ৫৩ বছরের অদল-বদল রাজনীতির পরিবর্তে নতুন ধারার রাজনীতির জন্যই মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে বেছে নেবে। চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসমুক্ত মানবিক বাংলাদেশ গড়তে জামায়াতের বিকল্প নেই। তাই জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে মানুষ ভুল করবে না বলে আমি শতভাগ আশা করছি।
এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বাসদ মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন দলটির বরিশাল জেলার সমন্বয়ক ডা. মনীষা চক্রবর্তী। যিনি বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ভূমিকা রেখেছেন। আন্দোলন করতে গিয়ে হামলা, মামলা এবং কারাবরণও করেছেন তিনি। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন এবং করোনা মহামারিতে ডা. মনীষা চক্রবর্তীর অবদান অনেক ক্ষেত্রে স্মরণীয় হয়ে আছে নাগরিকদের কাছে।
তাছাড়া খেলাফত মজলিসের একাংশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন অধ্যাপক একেএম মাহবুব আলম এবং খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক) অংশ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে মুফতি সুলতান মাহমুদকে। যদিও ইসলামিক দলে ঐক্যের প্রশ্নে তারা ছাড় দিতে রাজি বলে জানিয়েছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। এর বাইরে সুযোগ পেলে জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন তাপসও প্রার্থী হতে পারেন বলে আলোচনা রয়েছে।
বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) ॥ জেলার সীমান্তবর্তী এই আসনেও বইছে নির্বাচনী হাওয়া। এখানে দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। এবারের প্রেক্ষাপটে আসনটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া বিএনপি। আর নতুন করে আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছেন জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলের নেতারা।
ত্রয়োদশ নির্বাচনে এখানে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক এমপি ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান, কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক নুরুল ইসলাম খান মাসুদ, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতা সোলায়মান সেরনিয়াবাত এবং বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস আবু জাফর শিকদার বাদল। এর মধ্যে অভিজ্ঞ, ত্যাগী ও গঠনমূলক নেতৃত্বের কারণে অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজনকে ঘিরে এ আসনে বিএনপির রাজনীতিতে নতুন গতি ফিরেছে।
অপরদিকে এখানে জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা শাখার সেক্রেটারি মাওলানা মাহমুদুন্নবী। এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী দলের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন মুহাম্মদ মিজানুর রহমান।
অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন বলেন, প্রচার চালাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। দলের মনোনয়নের বিষয়েও আমি আশাবাদী। জামায়াতের মনোনয়ন পাওয়া মাওলানা মাহমুদুন্নবী বলেন, প্রচার চালাতে গিয়ে সাধারণ ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
বরিশাল জেলার ছয়টি আসনেই একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী থাকার বিষয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও বরিশাল বিভাগীয় দলনেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, অন্য দলের সঙ্গে আমাদের তুলনা করে লাভ নেই। তাদের প্রার্থী খুঁজতে হয়, আর আমাদের প্রার্থী বাছাই করতে হয়। ক্লিন ইমেজের যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করে বিএনপি। তিনি বলেন, বিএনপি একটা বড় দল। এই দলে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, আছে প্রতিযোগিতা। গণতান্ত্রিক দলে প্রতিযোগিতা বেশি থাকা স্বাভাবিক। আর দেশের জনগণের চাওয়াই বিএনপির চাওয়া। আর সেটা হলো জাতীয় নির্বাচন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন এবার ক্লিন ইমেজের প্রার্থীদের হাতে ধানের শীষ তুলে দেওয়া হবে। তার কথার কোনো ব্যত্যয় হবে না।