
দক্ষিণে সাগরতীরের শেষ জনপদ বরগুনা-১ (সদর-আমতলী-তালতলী) ও পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) সংসদীয় এলাকা। এগুলোর পাশের আসন পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা)। এই তিন আসনের ক্ষেত্রে একটি মিল আছে। বিএনপি এ পর্যন্ত এসব আসনে জিততে পারেনি। পিরোজপুর-১ (সদর-ইন্দুরকানী-নাজিরপুর) ও পিরোজপুর-২ আসনেরও একই অবস্থা। মাত্র একবার জিততে পেরেছে পটুয়াখালী-২ (বাউফল) ও পিরোজপুর-৩ আসনে। বরিশাল বিভাগের ২১টি আসনের মধ্যে এই সাতটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল।
আগামী নির্বাচনে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে না পারলে বিএনপির জেতার বড় সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবে কিনা, এ নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন। প্রতিটি আসনে দলটির একাধিক পক্ষ আছে। কোন্দল অনেকটা প্রকাশ্য। অন্যদিকে, সুসংগঠিত জামায়াত তিনটি ও ইসলামী আন্দোলন দুটি আসনে ঘর গুছিয়ে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। এতে বিএনপির সম্ভাবনা ম্লান হতে পারে। এলাকাগুলোর বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীসহ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বরগুনা-১
স্বাধীনতা-পরবর্তী সব কটি নির্বাচনে বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগ জিতেছে। আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় ২০০১ ও ২০০৮ সালে বিএনপির সুযোগ এসেছিল। তবে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। দলের প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন। ২০০১-এ দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন। সেই সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাত্র এক হাজার ৩৭৬ ভোট পান।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এক লাখ ৩১ হাজার ৩৬৮ এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্রোহী দেলোয়ার হোসেন পান ৮০ হাজার ৫৯০ ভোট। বিএনপির মতিয়ার রহমান তালুকদার পান ২৪ হাজার ৬৮৬ ভোট। ভোটের এ চিত্র থেকে বোঝা যায় আসনটিতে বিএনপির অবস্থা শক্তিশালী নয়। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, এখন তাদের ভোট আছে, কিন্তু শক্তিশালী প্রার্থী নেই। দলে কোন্দলও আছে। টানা দুই বছর বরগুনা জেলা বিএনপির কমিটি ছিল না। গত ২৪ সেপ্টেম্বর আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে।
এবার প্রার্থী হতে মাঠে আছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম মোল্লা, কেন্দ্রীয় শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ফিরোজ জামান মামুন মোল্লা, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রেজভি উল কবির, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী তৌহিদ ও মহিলা দল নেত্রী আসমা আজিজ।
অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন কেওড়াবুনিয়ার পীর আব্দুল রশিদের ছেলে মাওলানা অলিউল্লাহকে ও জামায়াতে ইসলামী জেলা আমির মাওলানা মো. মহিবুল্লাহকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। সমঝোতা হলে অলিউল্লাহর প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
পটুয়াখালী-৪
পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার জন্য এলাকাটি সর্বাধিক পরিচিত। স্বাধীনতার পর থেকে এটি আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। বিএনপির প্রার্থী ১৯৯১ সালে ১০ হাজার ৮৭০ ভোটে, ১৯৯৬ সালে সাত হাজার ৭৪৪ ভোটে এবং ২০০১ সালে ১৩ হাজার ৮৪২ ভোটে, ২০০৮-এর নির্বাচনে ৩০ হাজার ২৫৪ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। ২০০৮ সালে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন এবিএম মোশারফ হোসেন। আসনের দুই উপজেলার বিএনপি বর্তমানে তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তাঁর মনোনয়ন পাওয়া প্রায় নিশ্চিত।
স্থানীয়দের মতে, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা আছে। তবে হিসাব জটিল করেছেন কলাপাড়া উপজেলার সাবেক সভাপতি ডা. মোস্তাফিজুর রহমান। ’৯৬ ও ২০০১-এর নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগ আমলে স্বতন্ত্র হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর তিনি ইসলামী আন্দোলনে যোগ দেন।
পটুয়াখালী-৩
এ আসনে প্রথমবার জয়ের স্বপ্ন দেখছে বিএনপি। একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও আলোচনায় সাবেক ছাত্রদল নেতা হাসান মামুন। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুর হক নুরু এ আসনে প্রার্থী হবেন। তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে সমঝোতা হলে আসনটি বিএনপিকে ছাড়তে হতে পারে। অনেকে বলছেন, এ ধারণা থেকেই গণঅধিকারের সঙ্গে বিএনপি একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
আগের ফল বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়, আসনটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি ছিল। ২০০৮ সালে রাজনীতিতে অচেনা মুখ গোলাম মাওলা রনির সঙ্গে ৫৮ হাজার ৫০৪ ভোটে হারে বিএনপি, যা ছিল রনির প্রাপ্ত ভোটের অর্ধেক। এর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পরাজয়ে ব্যবধান ছিল ১৯৯১ সালে ৩২ হাজার ৫১১ ভোট, ১৯৯৬ সালে ১৪ হাজার ৫৩৮ এবং ২০০১ সালে ১২ হাজার ৭৪৮ ভোট।
পিরোজপুর- ১
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি এ আসনে জামায়াতের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জিতেছেন। বিএনপির কাছে আসনটি এখনও অধরা। গত বছর ৫ আগস্টের পর দল গোছানোর বদলে স্থানীয় বিএনপি কোন্দলে জড়ায়। কোন্দল চরমে পৌঁছালে গত ৪ সেপ্টেম্বর জেলা আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর চার সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, সাঈদীপুত্র মাসুদ সাঈদী সরকার পতনের পর থেকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, সুসংগঠিত দল ও পিতার ইমেজ থাকায় তিনি শক্ত অবস্থানে আছেন। অন্যদিকে, বিএনপির তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী– জেলা আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম খান, সাবেক আহ্বায়ক অধ্যাপক আলমগীর হোসেন ও কেন্দ্রীয় সদস্য এলিজা জামানকে ঘিরে রয়েছে বিভক্তি। এ ছাড়া সাংবাদিক সাঈদ খান, অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান দুলাল, জাহাঙ্গীর আলম দুলালও মনোনয়নপ্রত্যাশী।
পিরোজপুর-২
স্বাধীনতার পর আসনটিতে জিতেছিল আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ১৯৮৬ সাল থেকে সাতবার ও তাঁর স্ত্রী একবার এমপি হন। এটি মঞ্জুর আসন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ অঘোষিতভাবে মঞ্জুকে সমর্থন দিয়ে আসছে। আগামী নির্বাচনেও মঞ্জু এখানে প্রধান ফ্যাক্টর বলে ভোটাররা বলছেন। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচনায় আছেন মঞ্জুর চাচাতো ভাই মাহমুদ হোসেন, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সুমন মঞ্জুর ও ফখরুল ইসলাম। জেলা নেতাদের দ্বন্দ্বের প্রভাবে এ নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি কয়েক ভাগে বিভক্ত।
অন্যদিকে, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আরেক ছেলে শামীম সাঈদী জামায়াত থেকে নির্বাচন করতে এক বছর আগে থেকে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি শক্ত অবস্থানে আছেন বলে জানা গেছে।