
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর বুধবার (১৫ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন। তিন যুগ পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটের আয়োজন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন ছিল আগ্রহ, তেমনি ছিল উত্তেজনাও। এদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু হয় ১৪টি হল ও ১টি হোস্টেল সংসদের নির্বাচন, যা শেষ হয় বিকেল ৪টায়। নির্বাচনের পর রাত ৮টা থেকে আসতে থাকে হলগুলোর ফলাফল। আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় সংসদের ফলাফল ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ মিলনায়তনে ঘোষণা করা হয় বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) ভোর সাড়ে ৪টা থেকে।
সম্প্রতি ডাকসু-জাকসুর পর চাকসুতেও ভূমিধস বিজয় পায় ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থীরা। কেন্দ্রীয় সংসদের মোট ২৬টি পদের মধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদকসহ (জিএস) মোট ২৪টি পদে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে প্যানেলটি। বাকি একটিতে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে ও আরেকটিতে জিতেছেন বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের প্রার্থী।
ভিপি পদে ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের শিবিরের সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন রনি। এ ছাড়া জিএস পদে ৮ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন একই বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের দপ্তর সম্পাদক সাঈদ বিন হাবিব।
অন্যদিকে শিবির প্যানেল ছাড়া যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ৭ হাজার ১৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক ও সহ-খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক তামান্না মাহবুব প্রীতি। তার প্রাপ্ত ভোট ৪ হাজার ৩১। ফলাফল ঘোষণার সময় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্লোগান ও উচ্ছ্বাস করতে দেখা গেছে।
শিবির প্যানেল থেকে নির্বাচিত অন্যরা হলেন সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক হারেজুল ইসলাম (হারেস মাতাব্বর), সহ-সাহিত্য সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক জিহাদ হোসাইন। দপ্তর সম্পাদক পদে আব্দুল্লাহ আল নোমান, সহ-দপ্তর সম্পাদক পদে জান্নাতুল আদন নুসরাত, ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক হিসেবে নাহিমা আক্তার দ্বীপা, সহ-ছাত্রী কল্যাণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস রিতা।
এ ছাড়া বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান, গবেষণা ও উদ্ভাবন সম্পাদক তানভীর আঞ্জুম শোভন, সমাজসেবা ও পরিবেশ সম্পাদক তাহসিনা রহমান, স্বাস্থ্য সম্পাদক আফনান হোসাইন ইমরান, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক মো. মোনায়েম শরীফ, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক মেহেদী হাসান সোহান, যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক মো. ইসহাক ভূঞা, সহ-যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক পদে ওবায়দুল সালমান, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক ফজলে রাব্বি তৌহিদ, পাঠাগার ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ।
এ ছাড়া নির্বাহী সদস্য হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন, জান্নাতুল ফেরদৌস সানজিদা, আদনান শরীফ, আকাশ দাশ, সালমান ফারসী ও মো. সোহানুর রহমান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ৪৪ বছর পর চাকসুতে এ এক ‘ভূমিধস বিজয়’, যার পেছনে রয়েছে কিছু সুস্পষ্ট কারণ। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময় থেকে ক্যাম্পাসে বেশিকিছু কল্যাণমূলক কার্যক্রম করেছে সংগঠনটি। এছাড়া তাদের প্যানেল এই নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে প্রচারণার কৌশল, ক্যাম্পাসে স্মার্ট মুভ প্রভৃতি চাকসুতে ভূমিধস জয়ের অন্যতম কারণ।
শিক্ষার্থীদের কল্যাণে দীর্ঘমেয়াদি কাজের ধারাবাহিকতা
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিগত ১ বছর ধরে ক্যাম্পাসে বেশিকিছু কল্যাণমূলক কার্যক্রম করেছে শিবির। রমজানে শিক্ষার্থীদের ফ্রি ইফতার কর্মসূচি, ফ্রেশারস রিসেপশন, কোরআন বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এসব কাজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ধারাবাহিকভাবে এই কাজগুলো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। এ জন্য শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দ করেছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
সততা ও শৃঙ্খলা
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর প্রকাশ্যে রাজনীতি মতে ফিরেছে শিবির। বিভিন্ন দমন পিড়নের কারণে দীর্ঘদিন রাজনীতি করতে পারেনি সংগঠনটি। সরকার পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সংঘাতে জড়াইনি শিবির। ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব বা হট্টগোলের সঙ্গে তাদের নাম সেভাবে নেই। ভোটারদের চোখে তারা হয়ে উঠেছেন সৎ রাজনীতির প্রতীক। এটিও তাদের ভূমিধস জয়ের অন্যতম কারণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘শিবিরকে তেমন কোনো সংঘর্ষ বা সংঘাতে জড়াতে দেখিনি বরং তাঁর প্রকাশ্যে আসার পর একের পর এক শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির অভিযোগ নেই। এ জন্য শিক্ষার্থীরা এই প্যানেলকে নির্বাচিত করেছেন।’
প্রচারণা কৌশল
ভোটের আগে ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে খুবই পরিকল্পিতভাবে প্রচারণা চালিয়েছে। তারা প্রতিটি অনুষদ, আবাসিক হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তারা কার্যকরভাবে প্রচার চালিয়েছে—সংক্ষিপ্ত ভিডিও, ইস্যুভিত্তিক পোস্ট ও লাইভ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নিজেদের পরিকল্পনা তুলে ধরেছে। প্রচারণায় আবেগ নয়, যুক্তি ও কর্মপরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে তারা, যা শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল
ডাকসু, জাকসুর মতো চাকসুতেও তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল গঠন করেছে। যেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী, নারী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পদে সৎ, দক্ষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা তাদের জয়ের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে।
শিক্ষার্থী মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের ছাত্ররাজনীতি চলতে থাকায় নতুন নেতৃত্বের প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। তারা এমন নেতৃত্ব চেয়েছেন যারা ক্যাম্পাসে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে, শুধু দলীয় স্বার্থ নয়—সাধারণ শিক্ষার্থীর স্বার্থে কাজ করবে। ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে, যা ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছে।
ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব ও শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো
জোটের ভেতরে ঐক্য ও সমন্বয় ছিল প্রশংসনীয়। প্রতিটি পদে প্রার্থী নির্বাচন থেকে শুরু করে ভোটের দিন পর্যন্ত তারা একসঙ্গে কাজ করেছে। সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী হওয়ায় মাঠপর্যায়ে ভোটারদের সংগঠিত করা, ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা—সব ক্ষেত্রেই তারা ছিল এগিয়ে।
নির্বাচিত হয়ে চাকসুর জিএস সাঈদ বিন হাবিব বলেন, ‘এ বিষয় ব্যক্তিগত নয়, এটি ২৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিষয়। আমরা তখনই বিজয়ী হব, যখন আমাদের ৩৩ দফা ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে পারব। আমাদের প্যানেলে যারা জয়ী হয়েছেন সবাই নিজ নিজ জায়গায় দক্ষ। আমরা চাকসুকে কোনো দলীয় স্থান নয় শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের প্লাটফর্ম হিসেবেই ব্যবহার করবো। এজন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
উল্লেখ্য, এবারের চাকসু নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে মোট ৯০৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ৪১৫ জন, হল ও একটি হোস্টেল সংসদে ৪৯২ জন। কেন্দ্রীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৪৮ জন নারী প্রার্থী ও ৩৬৬ জন পুরুষ প্রার্থী। এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ২৭ হাজার ৫১৭জন। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৪৩৪ জন। যার মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১৭ হাজার ৭১৪ জন ভোটার।