
“কোনো দলের ওপর আমাদের ক্ষোভ নেই, ক্ষমা করে দিলাম”। “আমরা জুলুম-নির্যাতনকারীদের ক্ষমা করে দিয়েছি”। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ওই বক্তব্য দেন যথাক্রমে বিগত ২৮ আগস্ট’২৪ইং এবং ৩ সেপ্টেম্বর’২৪ইং ঢাকায় দু’টি অনুষ্ঠানে। তখন সদ্য গণঅভ্যুত্থানে উৎখাত পলাতক হাসিনার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দিকেই ইঙ্গিত করে (নামোল্লেখ না করে) জামায়াত আমিরের দেয়া হঠাৎ ‘মাফ’ বয়ান ঘিরে সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া, সন্দেহ ও বিতর্ক তৈরি হয়। দলটিরর ভেতরেও ওঠে নানান গুঞ্জন। সচেতন জনমনে প্রশ্ন ঘুরপাক খায় তাহলে কি দলটির হাত ধরে ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে? এরপর চট্টগ্রামের আরেকটি ঘটনা।
গত ৬ মে’২৫ইং সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী এক সভায় বলেন, “জামেয়া মাদরাসার প্রত্যেকটি হলে (৫ মে’ ২৫ইং) সেনাবাহিনী তল্লাশি চালিয়েছে। সেখান থেকে অনেক অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে এবং অস্ত্রগুলো ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের”। এশিয়াখ্যাত প্রাচীন দ্বীনি বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা কাজী আবদুল আলীম রিজভী তাৎক্ষণিক জাময়াত নেতার ওই বক্তব্যে বিস্ময়, প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিগত ৭১ বছরে জামেয়ায় কোনো বাহিনীর কোনো অভিযান কখনোই পরিচালনা হয়নি। এ বক্তব্যে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান জামেয়ার এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম চরমভাবে ক্ষুণœ হয়েছে।
চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সুন্নি আলেম-মাশায়েখগণ উক্ত বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। অবশ্য ৭ মে জামায়াত নেতা এক তার ফেসবুক পেজে ভিডিও বার্তায় ‘দুঃখ প্রকাশ’ করে শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘তথ্যগত বিভ্রাট ঘটায় আমার কথায় জামেয়ায় তল্লাশি প্রসঙ্গে একটি ভুল তথ্য উঠে আসে’। এরপর ১৩ জুন জামায়াতের কেন্দ্রের নির্দেশে শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম নগর জামায়াতের আমির পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তবে তাকে আমিরের পদচ্যূত করার সঙ্গে জাময়াতের উদ্যোগে চট্টগ্রাম নগরীর বির্জা খাল সংস্কার কাজ নিয়ে নয়-ছয় বিতর্কও জড়িয়ে আছে।
অতিসম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর বক্তব্যে দেশব্যাপী তোলপাড় চলছে। দেশের এই প্রবীণ আলেমেদ্বীন সুস্পষ্ট ভাষায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে ভোট না দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। গত শুক্রবার (৩ অক্টোবর) চট্টগ্রামের হাটহাজারী পার্বতী মডেল সরকারি হাইস্কুল অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শানে রেসালত সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হেফাজত আমির আরো বলেন, ‘জামায়াতের নেতারা পূজা আর রোজা একই বলে, এগুলো কি ইসলাম? দেওবন্দী উস্তাদ-মুরব্বী হযরতগণ অনেক আগেই আমাদের বলে গেছেন, মওদুদীর ফিৎনা কাদিয়ানীর চাইতেও বড় ফিৎনা, কুফরি ফিৎনা। মওদুদী ফিৎনা প্রতিহত না করলে বাংলাদেশে আর মুসলমান থাকবে না। সকলের কাছে আমি আবেদন করছি কুফরি প্রতিষ্ঠার জন্য জামায়াতকে সামনের নির্বাচনে কেউ সমর্থন দিবেন না। এটা সবার কাছে প্রচার করুন।
বাবুনগরী বলেন, মওদুদীর জামায়াত পয়গাম্বর ও সাহাবীদের মাসুম নিষ্পাপ বলে মানে না, সত্যের মাপকাঠি মানে না, বরং তাঁদের সম্পর্কে সমালোচনা করে। সাহাবীরা নাকি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তাহলে কী ঈমান থাকে? এমনকি খলিফা হযরত ওমরের (রা.) চরিত্র হনন করে জঘন্য ভাষায় সমালোচনা করে। যা হুজুরের (সা.) জামানায় কাফেররাও কখনো করেনি। ঈমান থাকলে এসব কথা বলে এদেশে থাকতে পারেনা। অথচ রাসূল (সা.) বলেন, আমার পর আর কেউ যদি পয়গাম্বর আসতেন ওমরই (রা.) হতেন পয়গাম্বর। যিনি ছিলন উত্তম চরিত্রের জন্য প্রশংসিত। হযরত ওমরকে (রা.) দেখলে ভয়ে শয়তান পালিয়ে যেতো।
তিনি বলেন, মওদুদী ফিৎনা কাদিয়ানীর চাইতেও বড় ফিৎনা। কারণ কাদিয়ানীরা অমুসলিম একথা সবার জানাশোনা। কিন্তু মওদুদীর ফিৎনা মুসলমানদের ভিতরে থেকেই ইসলামের গোড়া কেটে দিচ্ছে। আমাদের উস্তাদ আলেমগণ বহু আগেই বিভিন্ন সময়ে বলে আমাদেরকে সতর্ক করে গেছেন, জামায়াতের ইসলাম মওদুদীর ইসলাম। মদীনার ইসলাম নয়। আমাদের ইসলাম মৌলবাদী ইসলাম নয়; মদীনার ইসলাম। আল্লাহ আমাদের মওদুদীর ফিৎনা থেকে বাঁচান। প্রসঙ্গত হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর উপরোক্ত বক্তব্যের বিষয়ে এখন পর্যন্ত জামায়াতের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা বা প্রত্যুত্তর আসেনি। আল্লামা বাবুনগরী এরআগেও জামায়াতের মতবাদ এবং কর্মকা- নিয়ে প্রশ্ন ও কঠোর সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল, সভা-সমাবেশে।
এদিকে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণের ‘চ্যালেঞ্জ গ্রহণে’র কথা দলটির শীর্ষ নেতারা বলে আসছেন। কেন্দ্রীয় নির্দেশে জাময়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী ও নগর-জেলা-উপজেলার নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আগেভাগে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা, গণসংযোগের শোডাউনে অনেক জায়গায় মাঠে নেমেছেন। তবে জামায়াতের কেন্দ্রীয়, মধ্যমসারি ও প্রান্তিক নেতাদের দেয়া নানান বক্তব্য-মন্তব্য নিয়ে রাজনীতি সচেতন সাধারণ জনগণের মাঝে গিয়ে সর্বত্রই প্রশ্নবাণে জর্জরিত জামায়াত। আসলেই দলটি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায় কিনা? নাকি গণভোট চায়? নাকি পিআর পদ্ধতিতে (সংখ্যানুপাতিক আসন) নির্বাচন চায়? জুলাই সনদে তারা কী পেতে চায়? দলের নেতাদের দ্বিমুখী-তিন-চারমুখী এজেন্ডা বাস্তবায়নের আবদার, ভোটের আগেভাগে চলমান আন্দোলনের কর্মসূচিকে ঘিরে জামায়াত জনসম্মুখে হাজির হওয়া সুখকর হচ্ছে না। আবার জামায়াতের যে মূল দাবি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন এ সম্পর্কে প্রাথমিক কোনো ধারণাই নেই শতকরা ৯০ ভাগ শহর-গ্রাম-গঞ্জের মানুষের। গণভোটের কী মর্ম তাও দেশের অধিকাংশ ভোটারের।
বরং আসন্ন নির্বাচনে যাওয়া বনাম দাবি আদায় কোনটি আগে-পরে? এই প্রশ্নে জাময়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে নেতাদের এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা ও দোদুল্যমানতা ফুটে উঠছে। জামায়াতের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও ওপরের দিকের নেতাদের কাছে জানতে চাইছেন জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেবে? নাকি পিআর কিংবা গণভোট (দলের দাবি মাফিক) ছাড়া নির্বাচনে যাবে না; বর্জন করবে? এসব প্রশ্ন ও বিতর্ক থেকে অনেকেই বলছেন, জামায়াত বহুরূপী সংগঠন। যখন যেখানে প্রয়োজন সময় সুযোগ মতো একেক রকম বক্তব্য ও ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়। কখনো স্বৈরাচার এরশাদের মিত্র, কখনো বিএনপির জোটসঙ্গী হয়ে ক্ষমতার স্বাদ ভোগ, কখনো ফ্যাসিস্ট হাসিনার পাশে থাকা- এভাবে ক্ষণে ক্ষণে রঙ ও ভোল পাল্টানোর রাজনীতি চলে আসছে এদের।
এরই সাথে জামায়াত নেতাদের ভোট রাজনীতির নামে সাম্প্রতিক দূর্গাপূজায় সংখ্যালঘু কার্ডকে কাজে লাগানোর চেষ্টাপ্রসূত ‘পূজা আর রোজা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ’ ইত্যাদি ধরনের নতুন কথাবার্তার রহস্য কি তা নিয়েও চলছে জনেজনে গুঞ্জন। জামায়াত-ঘরানার চট্টগ্রামের কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম-ওলামা-খতিবের সঙ্গে আলাপকালে তারা জামায়াত নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও মন্তব্যে ত্যক্ত-বিরক্ত বিব্রত বলে জানিয়েছেন।
তদুপরি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে এক সভায় দেয়া বক্তব্যে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের ভারতের সম্ভাব্য আক্রমণের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, আমি বলেছি দোয়া করতেছি এরা যেন ঢুকে পড়ে। ভারত ঢুকলেই আমাদের সেই বদনাম যাবে, যা ১৯৭১ সালে চাপানো হয়েছিল। তখন আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করার একটা সুযোগ পাবো। কমপক্ষে ৫০ লাখ যুবক তো ভারতের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে আসবে’। রাসূলের (সা.) গাজওয়া সম্পর্কিত হাদিসের বাস্তবায়ন তখন মহাপরিকল্পনা হয়ে দাঁড়াবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কেন ভারতকে আক্রমণের প্রকারান্তরে এই আহ্বান?
তাছাড়া দলটির দীর্ঘদিনের প্রচলিত স্লোগান ‘আল্লাহর আইন চাই- সৎ লোকের শাসন চাই’ হঠাৎ করেই গুডবাই জানানো, দলীয় লোগো পরিবর্তন-বিতর্ক ইত্যাদি নিয়ে অবিরত প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে সর্বপর্যায়ের জামায়াত নেতাদের। সন্দেহ-সংশয় প্রশ্ন-বিতর্ক জামায়াতের পিছু ছাড়ছেই না।