টিউলিপ ও বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পরিবারের পতনের নেপথ্যে যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমন মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির তদন্তে নাম আসার পর পদত্যাগ করেছেন। টিউলিপের খালা বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মা শেখ রেহানাসহ পরিবারের বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সদস্যের বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ উঠেছে। ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি মামলা হয়েছে। ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার সরকারের বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। Advertisement রয়েছে বড় মাপের আর্থিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগও।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে তার ক্ষমতা থেকে পতনকে ঘিরে সহিংস সংঘর্ষে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে। বাংলাদেশের নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার আমলে সংঘটিত অপরাধ তদন্তে জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আইনি প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে টিউলিপ সিদ্দিকও রয়েছেন, যাকে দুর্নীতির মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে জবাবদিহি করতে বলা হতে পারে। টিউলিপ সিদ্দিকের নাম দুটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতি তদন্তে উঠে এসেছে বলে জানা গেছে। তবে তিনি বারবার তার বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
স্যার লরি ম্যাগনাসকে লেখা চিঠিতে টিউলিপ সিদ্দিক লিখেছেন, আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমি কোনো ভুল করিনি। তবে সন্দেহ এড়ানোর জন্য আমি চাই আপনি স্বাধীনভাবে সব সত্য উদঘাটন করুন। শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির জনক’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত দেশটিকে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করেছিলেন। এটি একটি নৃশংস ও রক্তাক্ত সংগ্রামের পরে এসেছিল; যা প্রায়শই ‘বাংলাদেশি গণহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
যেখানে ৩০ লাখ (মতান্তরে তিন লাখ) বাংলাদেশি নিহত এবং আরও এক কোটি বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি নারী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৭৩ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে নির্বাচিত হন। দুর্নীতি ও রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্যাতনের অভিযোগের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি, তার স্ত্রী, তিন ছেলে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য নিহত হন। শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন।
অবশেষে ১৯৯৬ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন। শুরুতে তাকে গণতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখা হলেও নিজের পদ ব্যবহার করে নিজেকে ও পরিবারকে সমৃদ্ধ করার অভিযোগ ওঠার পর হাসিনার ভাবমূর্তি দ্রুত বদলে যায়। অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে যা এখন সমালোচকদের দ্বারা ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ হিসেবে বিবেচিত, হাসিনার সরকার তার পরিবারের সকল সদস্যকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং আবাসনের অনুমতি দিয়ে বেশ কয়েকটি বিতর্কিত আইনও পাস করেছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগ শেখ হাসিনা ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তার মেয়াদে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতির কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। কিন্তু গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশিত শ্বেতপত্রের সাম্প্রতিক তথ্য থেকে বোঝা যায়, এ অগ্রগতি ছিল অনেকাংশেই বানোয়াট।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চুরি যাওয়া সম্পদ ফেরত দাবি করেছেন এবং শেখ হাসিনাসহ অন্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা বলেছেন। তবে ইউনূসের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনো অন্যায়ের কথা অস্বীকার করেছেন শেখ হাসিনা। নিউইয়র্কভিত্তিক এনজিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। শেখ হাসিনা এনজিওর অভিযোগও অস্বীকার করেছেন। ঢাকায় শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে (গণভবন) টিউলিপ সিদ্দিকের রাজনৈতিক প্রচারপত্র এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত বিলাসবহুল বেশ কয়েকটি আইটেম (গহনা, সোনার প্রলেপযুক্ত কলম, দামি পোশাক, উপহার) পাওয়া গেছে। তদুপরি, রূপপুর পারমাণবিক চুক্তিতে টিউলিপের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওই চুক্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা হয়। টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে ফৌজদারি মামলা করেছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ যখন তার নবগঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের পথে হাঁটছে তখন টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। সূত্র: এশিয়া টাইমস লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যান্ড গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট, ইউনিভার্সিটি অব এসেক্স , যুক্তরাজ্য অনুবাদ: সজীব হোসেন