Image description

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ‘জুলাই-কন্যা’দের সার্বিক উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে পরিকল্পনার অংশ হিসাবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের হত্যাযজ্ঞ-বুলেট-নির্যাতনের সামনে দাঁড়িয়ে রাজপথ থেকে অলিগলি-সর্বত্রই ছিল বীর কন্যাদের উপস্থিতি। বীর কন্যাদের খুঁজে বের করে তাদের পরিচয়পত্র প্রদানসহ আর্থিক-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তাদের জন্য মন্ত্রণালয়ে নতুন বিভাগসহ সারাদেশের দপ্তরগুলোয় বিশেষ সেল/ডেস্ক তৈরি করা হচ্ছে। জুলাই-কন্যারা এমন উদ্যোগের প্রশংসা জানিয়ে বলছেন, শুধু তারা নন, সব নারীর উন্নয়ন-নিরাপত্তা-সম্মান নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করবে বলে তারা আশাবাদী। বৈষম্য আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজপথেই থাকবে ‘জুলাই-কন্যারা’।

এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার বিকালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা শারমীন এস মুরশিদ যুগান্তরকে বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রতিটি মিছিল-মিটিংয়ের সামনে ছিল কন্যারা। ‘জুলাইকন্যা-বীরকন্যা-অগ্নিকন্যা’ খ্যাত মেয়েদের উন্নয়নে যা যা করার দরকার, সবই করা হবে। প্রত্যেক জুলাই-কন্যাকে খুঁজে বের করে তাদের পরিচয়পত্র প্রদান করা হবে। তাদের শিক্ষাজীবন এবং শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থান, আর্থিক উন্নয়নেও মহাপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আমরা কাজ শুরু করেছি। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিশেষ বিভাগ খোলাসহ সমগ্র দেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় ‘জুলাই-কন্যা’ কর্নার স্থাপন করা হবে।

শারমীন এস মুরশিদ আরও বলেন, জুলাই বীরকন্যারা মিছিলের সামনে ছিলেন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের হত্যাযজ্ঞ-বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগানের পর স্লোগান দিয়েছেন। হামলার শিকার হয়েছেন। নির্দ্বিধায়-নির্ভয়ে যুদ্ধে নামা জুলাই-কন্যারা আমাদের শক্তি। তাদের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সবই করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে। তাদের সঙ্গেই আছি, থাকব। অর্থনৈতিকভাবে তারা যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে, এজন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বীর কন্যারা এখনো মাঠে রয়েছে। যে কোনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে।

এদিকে যুগান্তরের সঙ্গে একাধিক জুলাই-কন্যা কথা বলেছেন। তারা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা শারমীন এস মুরশিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে অনুরোধ জানিয়েছেন, শুধু জুলাই-কন্যা নয়, প্রতিটি নারীর নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়। তাদের নিয়ে যে উদ্যোগ, তা যেন বাস্তবায়ন করা হয়। এতে নারীদের মধ্যে প্রতিবাদী, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি আরও দৃঢ় হবে। এটাও বলেছেন, আন্দোলনে সর্বস্তরে নারীদের ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে সংস্কার কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১৩৫ শিশু ও ১১ জন নারী শহিদ হয়েছেন। অসংখ্য নারী আহত হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ও ভাষা সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী মিতু আক্তার যুগান্তরকে জানান, ১৪ জুলাই তিনিসহ আরও অনেক ছাত্রী শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট-ন্যক্কারজনক বক্তব্যের প্রতিবাদে স্লোগানে স্লোগানে ঢাবি এলাকা কম্পিত করে তুলেন। তার দরাজ কণ্ঠে উঠে ‘তুমি কে-আমি কে, রাজাকার-রাজাকার। কে বলেছে-কে বলেছে, স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’। ‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। মিতু আরও বলেন, উপদেষ্টা ম্যাডাম (শারমীন এস মুরশিদ) যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা খুবই প্রশংসনীয়। আমরা বিশ্বাস করি, তার উদ্যোগ নিশ্চয় বাস্তবায়ন হবে। হাজার হাজার জুলাই-কন্যা আজও মাঠে-ময়দানে আছে। তাদের অনেকে টিউশন হারিয়েছে। এখন আর্থিক সমস্যায় পড়েছে। ম্যাডাম কিংবা সরকারের এ উদ্যোগ জুলাই-কন্যাদের সহায়ক হবে।

ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিনা তাম্মিম হাপসা বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়ে আমরা হল ছেড়েছি। জীবন দিতে রাস্তায় নেমেছি। মিছিলের সামনে জীবন দিতে টানা হেঁটেছি। ভাই-বন্ধুদের রক্ষা করতে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছি। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল করেছি। সবই করেছি ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে। বৈষম্যহীন একটি দেশ গড়তে। এখনো যখন দেখি রাষ্ট্র-সমাজব্যবস্থায় বৈষম্য, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম-সংগ্রাম; দালালি না রাজপথ, রাজপথ-রাজপথ; আমার খায়-আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে; তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে; এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়।’ এমন স্লোগানগুলো পুরো আন্দোলনে শক্তি জুগিয়েছে-যোগ করেন তানজিনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সীমা আক্তার বলেন, জীবন দিতেই রাস্তায় নেমেছিলেন। কত অপবাদ-অপমান সইতে হয়েছে। ওই সময় একটাই সিদ্ধান্ত ছিল-জীবন দিয়ে হলেও ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করব। একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ব। আমাদের কথা হয়তো দেশের মানুষ ভুলে যাবে-বলেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন সীমা। বললেন, জীবন দিতে চেয়েছিলাম একটি সুন্দর দেশ গঠনে। এখন আমাদের নিয়েও মানুষ ভাবছে। আমি ঘুমাতে পারি না, চোখের সামনে রক্তাক্ত লাশ আর আমার ভাই-বোন-বন্ধুদের আর্তনাদ শুনি। আমি চাই, জুলাই-কন্যারা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকুক। একই সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের যথাসময়ে চিকিৎসা না হওয়ায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুন নাহার কর্ষী বলছিলেন, জুলাই-কন্যাদের পরিচয়পত্র প্রদান, অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ নিরাপত্তা নিশ্চিতে এমন উদ্যোগ নারী উন্নয়ন ও জাগরণে ইতিহাস হয়ে থাকবে। এমন বক্তব্য সব উপদেষ্টার কণ্ঠে উঠুক। ঘর-বাইরে-অন্দরমহলে নারীদের জীবন নিরাপদ হোক। কর্ষী বলেন, আমরা যখন বুলেটের সামনে বুক পেতে স্লোগান দিচ্ছিলাম, তখন একাত্ম হয়েছিল ছাত্র-জনতার সঙ্গে রিকশাচালক ভাইয়েরাও। নারীদেরও হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড, পোস্টার। যে পোস্টারে লেখা ছিল জহির রায়হান থেকে শুরু করে হেলাল হাফিজের কবিতা। উঠে এসেছিল কার্টুনে কার্টুনে ব্যঙ্গচিত্র।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অগ্নিকন্যাদের পোস্টারে লেখা ছিল-ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের সাড়াজাগানো ‘ইনকিলাব জিন্দবাদ’ থেকে ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমিই বাংলাদেশ’। রাজধানী থেকে গ্রামাঞ্চল, ফুটপাত, দেওয়াল, কিংবা যে কোনো বাউন্ডারিতে নারীদের রংতুলির লেখা ছিল সবচেয়ে দৃশ্যমান। জীবনবাজি রেখে জুলাই-কন্যারা শুধু দেওয়াললিখন নয়, আহত ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। হাসপাতালে আহতদের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিয়েছেন। আহতদের বাঁচাতে রক্ত দিয়েছেন, রক্ত সংগ্রহ করেছেন।