তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ন্যক্কারজনক অভিযান চালানো হয়। ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ নাম দিয়ে চালানো গভীর রাতের এ ভয়াবহ ক্র্যাকডাউনে মতিঝিল-শাপলা চত্বর এলাকা বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় বহু লোক হতাহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করতে শিগ্গিরই প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করবে হেফাজতে ইসলাম।
এদিকে এ ঘটনায় হেফাজতে ইসলাম মামলা করায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ১৩ বছর আগে ঘটে যাওয়া নারকীয় এ ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারা, কীভাবে জড়িত এবং এর মাস্টারমাইন্ড কারা ছিলেন, তা উদ্ঘাটন করতে পুলিশের কাছে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। জড়িতদের মধ্যে অনেকের নাম-পরিচয় এবং ওই রাতে তাদের কী ভূমিকা ছিল, এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে তথ্য আসতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পাঠানো তথ্যে অনেকের মুখোশ উন্মোচন হয়েছে। এ সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণের অনুলিপি যুগান্তরের হাতেও এসেছে।
গত ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালের সহকারী পরিচালক এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফতেহ্ মো. ইফ্তেখারুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে সাবেক সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলীয় নেতৃত্ব এবং সশস্ত্র ব্যক্তিরা পরিকল্পিতভাবে শাপলা চত্বর, মতিঝিল এবং এর আশপাশ এলাকায় ব্ল্যাক আউট করে জমায়েত হওয়া নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। এতে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এ মর্মে প্রাপ্ত অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্তাধীন রয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলা সুষ্ঠু ও যথাযথ তদন্তের স্বার্থে নিম্নবর্ণিত তথ্যাদি জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।
জানতে চাইলে ফতেহ্ মো. ইফ্তেখারুল আলম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে, এর পুরোটা এখনো পাওয়া যায়নি। শিগ্গিরই হয়তো সব তথ্য এসে পৌঁছাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়।
চিঠিতে অভিযান সম্পর্কিত আট ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সমাবেশ ঘিরে ডিএমপির নিরাপত্তা পরিকল্পনার সত্যায়িত কপি, অভিযানে ব্যবহৃত এপিসি (আর্মড পারসোনেল ক্যারিয়ার), কমান্ড ভেহিক্যাল ও রায়টকার চালকদের নাম, পদবি ও মোবাইল নম্বর। এছাড়া অপারেশনে ইস্যুকৃত অস্ত্রের ধরন, গুলি, ব্যবহৃত গোলাবারুদের হিসাব এবং গুলিবর্ষণের ঘটনায় কোনো প্রশাসনিক তদন্ত হয়ে থাকলে প্রতিবেদনের সত্যায়িত কপি, এজাহার এবং পুলিশ রিপোর্টের কপি দিতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে তৎকালীন কমিশনারসহ ডিএমপির সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও সুনির্দিষ্টভাবে ১০ জন কর্মকর্তার তথ্য চাওয়া হয়। তারা হলেন পুলিশের মতিঝিল বিভাগের তৎকালীন এডিসি (অতিরিক্ত উপকমিশনার) এসএম মেহেদী হাসান, এডিসি আসাদুজ্জামান, ট্রাফিক (পূর্ব) বিভাগের এডিসি মোহাম্মদ মাইনুল হাসান, রমনা বিভাগের এডিসি মনজুর রহমান, এডিসি আনোয়ার হোসেন, ডিবি (পশ্চিম) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মশিউর রহমান (বর্তমানে কারাবন্দি), ডিবির (দক্ষিণ) এডিসি নাসির উদ্দিন খান, লালবাগের তৎকালীন ডিসি আলোচিত কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদ এবং উপ-কমিশনার (ডিসি) খান মুহাম্মদ রেজোয়ান।
এর বাইরে ডিএমপির সব অতিরিক্ত কমিশনার, যুগ্মকমিশনার, ডিবিসহ সব বিভাগের ডিসি (উপকমিশনার), ডিসি ট্রাফিক (পূর্ব), ডিসি (অর্থ ও বাজেট), ডিসি (ইএন্ডডি), ডিসি (মিডিয়া), এডিসি ওয়ারী, এডিসি পিআরএইচআরডি, এডিসি প্রকিউরমেন্ট, ডিবির সব বিভাগের এডিসি, এসি, ওমেন সাপোর্ট সেন্টার ও ইনভেস্টিগেশন শাখার সহকারী কমিশনার, এসি (সহকারী কমিশনার) মতিঝিল ও খিলগাঁও জোন, এসি ট্রাফিক মতিঝিল ও রমনা জোন, এসি প্যাট্রল (মতিঝিল), পল্টন এবং ওয়ারী থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা), পল্টন, রমনা, হাজারীবাগ, সবুজবাগ এবং মতিঝিল থানার তৎকালীন ইনস্পেকটর তদন্ত পদে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের তথ্য দিতে বলা হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, হেফাজতের সমাবেশে পুলিশি অভিযান চালানো হয় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রীতিমতো সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার আগে তৎকালীন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ নিজেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বার্তা নিয়ে ডিএমপি সদর দপ্তরে হাজির হন। সেখানে তিনি পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ সময় তিনিসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও কয়েক দফা টেলিফোনে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি জানান, সৈয়দ আশরাফের উপস্থিতিতে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। পরে শেখ হাসিনাকে অভিযানের ছক সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। সব শুনে তিনি অভিযান শুরু করতে গ্রিন সিগন্যাল দেন। এরপরই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে শুরু হয় সমন্বিত সাঁড়াশি অভিযান। এ সময় মুহুর্মুহু গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে হেফাজতের নেতাকর্মীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। এতে ২০ মিনিটেরও কম সময়ে মাঠ পুরোপুরি দখলে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ঘটনার পর গণমাধ্যমকে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে বলা হয়, অভিযানে সরকারি বাহিনী নজিরবিহীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এতে সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি পুলিশ, র্যাব এবং প্রায় ১৮ প্লাটুন বিজিবি সদস্য অংশ নেন। এ সময় চাইনিজ রাইফেল ও শটগান ছাড়াও বিজিবি সদস্যরা এসএমজির মতো ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে ব্যাপক প্রাণহানির অভিযোগ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হেফাজতে ইসলাম দমন অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত হন। পরের বছর পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে অন্তত ২০ জন কর্মকর্তাকে পুলিশের সর্বোচ্চ পুরস্কার বিপিএম (বাংলাদেশ পুলিশ পদক) দেওয়া হয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা নিজে তাদের পদক পরিয়ে দেন। এ সময় পুরস্কৃত কর্মকর্তাদের ছবিসহ তাদের কর্মকাণ্ডের ভূমিকা বর্ণনা করে বিশেষ বুকলেট প্রকাশিত হয়।
হেফাজতের জমায়েত দমনে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য ‘পদক পেলেন যারা’ শিরোনামে পুলিশবাহিনী থেকে প্রকাশিত বুকলেটে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের ফিরিস্তির মধ্যে আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা (বর্তমানে পলাতক) হারুন-অর-রশিদ ওরফে ‘ডিবি হারুন’ ছিলেন অন্যতম। তার সম্পর্কে বলা হয়, ‘তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে স্বল্পসংখ্যক ফোর্স ও অফিসার নিয়ে হাজারো উচ্ছৃঙ্খল হেফাজত কর্মীকে কোনোরকম রক্তপাত তথা অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে সরাতে সক্ষম হন। তিনি জীবনবাজি রেখে উগ্রপন্থি মৌলবাদী হেফাজত কর্মীদের আস্তানায় অবস্থানকারী আহমদ শফীর সঙ্গে একাধিকবার ফলপ্রসূ আলোচনা করেন। একপর্যায়ে ব্যক্তিগত টাকা দিয়ে বিমানের টিকিট কেটে এবং নিজের গাড়িতে করে আহমদ শফীকে বিমানবন্দরে নিয়ে যান এবং ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় ফেরত পাঠান।’
হারুন ছাড়াও হেফাজতের ঘটনায় পদকপ্রাপ্ত হন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান, ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ, হাইওয়ে রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি আছাদুজ্জামান মিয়া, অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল জলিল মন্ডল, শেখ মুহাম্মদ মারুফ হাসান এবং পুলিশের বিশেষ শাখার তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুব হোসেন।
এদিকে ঘটনার ১৩ বছর পর এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে হেফাজে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, শেখ হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে ২৬ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। পাশাপাশি নির্ধারিত ফরমেটে মামলাও করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে হতাহতের সংখ্যা অনেক। রাতেই অনেকের লাশ গুম করে ফেলা হয়। সুনির্দিষ্টভাবে তাদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা প্রকাশের জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তালিকা প্রণয়নের কাজ করছে।