Image description
দেশজুড়ে বিভিন্ন মাত্রায় টিকার অভাব রয়েছে । কৌশলগত পরিকল্পনা না থাকায় সংগ্রহে জটিলতা । শিগগির সমাধানের আশ্বাস স্বাস্থ্যবিষয়ক সহকারীর । সরাসরি গ্যাভি থেকে টিকা কেনার পরিকল্পনা ।

গত সপ্তাহের শুরুতে ৯ মাস বয়সী মেয়েশিশুকে রাজধানীর রমনা এলাকায় ইপিআইয়ের এক স্থায়ী টিকা কেন্দ্রে নিয়ে যান বেসরকারি চাকরিজীবী বাবা । উদ্দেশ্য , হাম - রুবেলার ( এমআর ) প্রথম ডোজ দেওয়া । তবে সেদিন কেন্দ্রটিতে টিকা না থাকায় তাঁকে ফিরে আসতে হয় । এমআরসহ আরও কয়েক ধরনের টিকার ঘাটতির কারণে সেদিন শিশুসন্তানদের টিকা দেওয়া ছাড়াই ফিরতে বাধ্য হন অনেক অভিভাবক । শুধু ঢাকার রমনার কেন্দ্রটি নয় , দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিশুদের নিয়মিত টিকাগুলোর ক্ষেত্রে একই সংকট দেখা দিয়েছে ।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির ( ইপিআই ) আওতায় দেওয়া এসব টিকার সংকট চলছে কয়েক মাস ধরে । কোথাও সংকট তীব্র , কোথাওবা তুলনামূলক কম । সংশ্লিষ্টদের মতে , টিকা কেনা এবং তারপর সরবরাহ ব্যবস্থার জটিলতায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে । কর্তৃপক্ষ বলছে , এ সংকট দীর্ঘমেয়াদি হবে না । তথ্য অনুযায়ী দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে । টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য কিছু রোগ নির্মূলে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে ।

ইপিআইয়ের আওতায় সরকার বর্তমানে ১১ টি কর্মসূচিতে ৮ টি রোগের টিকা দেয় । নবজাতক থেকে ১১ মাস বয়সী শিশু , ২৩ মাস বয়সী শিশু , ১৫ বছরের কম বয়সী কিশোরী এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম নারীদের এসব টিকা দেওয়া হয় । যক্ষ্মা , পোলিও , ডিপথেরিয়া , হুপিংকাশি , ধনুষ্টঙ্কার , হেপাটাইটিস - বি , হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা - বি , হাম ও রুবেলা , নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া ও হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস ( এইচপিভি ) এসব রোগের টিকাদান সারা বছর চলে ।

ইপিআইয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে বিভাগীয় , জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , বিভিন্ন জেলায় বর্তমানে পিসিভি ( নিউমোনিয়া ) ও পেন্টাভ্যালেন্ট ( ডিপথেরিয়া , হুপিংকাশি , ধনুষ্টঙ্কার , হেপাটাইটিস - বি ও হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা - বি ) টিকার সংকট রয়েছে । তবে তিন মাস আগের তুলনায় অভাব কিছুটা কম । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান , তাঁর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সংকট পিসিভি টিকার । এ ঘাটতি সাত মাস ধরে চলছে । মাসখানেক আগে পৌঁছানো সর্বশেষ চালানটি সাত দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে ।

ওই কর্মকর্তা বলেন , দেশজুড়ে সব জায়গাতেই দু - তিন ধরনের টিকার অভাব রয়েছে । ১৯৭৯ সালে দেশের শহরগুলোতে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি ( ইপিআই ) চালু হয় । ১৯৮৫ সালে তা সারা দেশে বিস্তৃত হয় । বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে , এ কর্মসূচি চালুর আগে প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে মৃত্যুহার ছিল ১৫১ জন । ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২১ জনে । বাংলাদেশের ইপিআই কর্মসূচি জনস্বাস্থ্যে বড় সাফল্য হিসেবে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত । এর মাধ্যমে মা ও শিশুস্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে , শিশু মৃত্যুহার কমেছে এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে । এ টিকা কর্মসূচি পোলিও এবং মাতৃ ও নবজাতক ধনুষ্টঙ্কার ( এমএনটি ) নির্মূল করা এবং হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে । পাশাপাশি কিশোরী মেয়েদের মধ্যে ৯৩ শতাংশকে এইচপিভি টিকা দেওয়া যাচ্ছে , যা জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন গত আগস্টের শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিল , সেপ্টেম্বরে টিকা কেনায় দেরি হলে অক্টোবরের মধ্যেই মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে । অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটি সম্প্রতি ইপিআই কর্মসূচির জন্য টিকা কেনায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে । সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে ইউনিসেফের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ‘ গ্যাভি ’ থেকে টিকা সংগ্রহ করা হবে ।

প্রসঙ্গত, ‘গ্যাভি, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স ' হচ্ছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য সুলভে টিকা সহজলভ্য করতে গঠিত এক বৈশ্বিক উদ্যোগ । যেসব জেলায় টিকার সংকট বেশি রয়েছে , কুমিল্লা তার অন্যতম । কুমিল্লার ডেপুটি সিভিল সার্জন রেজা মো . সারোয়ার আকবর আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ টিকার সংকট গত অর্থবছরে বেশি ছিল , তবে সংকট কমেছে । আমরা নিয়মিত টিকা পাচ্ছি এবং শেষ হওয়ার আগেই আবার চাহিদা পাঠিয়েছি । সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় , কোন টিকার সংকট আছে । কারণ , একেক সময় একেক ধরনের টিকার অভাব হয় । ফলে কোনো একটির সংকটই স্থায়ী নয় । বর্তমানে পেন্টাভ্যালেন্ট ও পিসিভির সংকট রয়েছে । ' নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন , “ দেশে রুটিন ইপিআইয়ের টিকার সংকট রয়েছে । আগে স্বাস্থ্য খাতের পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের ( ওপি ) মাধ্যমে টিকা কেনা হতো , যা সহজ ছিল । নতুন ওপি না হওয়ায় বর্তমানে রাজস্ব খাত থেকে কেনা হচ্ছে । এই প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল । সচিব ও মন্ত্রী একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক পর্যন্ত অর্থের ক্রয়াদেশ দিতে পারেন । এর বেশি হলে তা সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হয় । দুজন সিভিল সার্জন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন , গত সপ্তাহে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা , জেলার সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ( স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ) একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন । তাতে টিকার সংকটের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে । ইপিআই সূত্রে জানা গেছে , চলতি অর্থবছরে সরকার টিকা কেনার জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে । এর মধ্যে সাড়ে আট শ কোটি টাকা দিয়ে ইপিআইয়ের নিয়মিত টিকা এবং বাকি অর্থ দিয়ে হাজিদের টিকা , জলাতঙ্কের টিকা ইত্যাদি কেনা হবে ।

কোল্ডস্টোরেজ থেকে টিকা জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে পাঠানো হয় এবং সেখানে সংরক্ষণ করে উপজেলা পর্যায়ে বিতরণ করা হয় । গত মঙ্গলবার থেকে জেলা চাহিদা অনুযায়ী টিকা পাঠানো শুরু হয়েছে । গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২০ টির বেশি জেলায় টিকা বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে । চাঁদপুরের সিভিল সার্জন মোহাম্মদ নুর আলম দীন জানিয়েছেন , জেলায় শিশুদের টিকার চলমান সংকট তিন দিন আগে শেষ হয়েছে । তিনি বলেন , ‘ আমাদেরও সংকট ছিল । তবে তিন - চার দিন আগে চাহিদা অনুযায়ী সব টিকা সরবরাহ পেয়েছি । যে টিকা এসেছে , তাতে দেড় মাস নির্বিঘ্নে চলবে । '

সিলেটের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মো . আনিসুর রহমান জানিয়েছেন , বিভাগের চার জেলায় মজুত টিকায় আগামী মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলতে পারে । স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক ( ইপিআই ) মো . শাহরিয়ার সাজ্জাদ বলেন , নিয়মিত অপারেশনাল প্ল্যান থেকে কার্যক্রম রাজস্ব খাতে চলে আসার কারণে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে । তবে এগুলো স্থায়ী নয় । দেশের কোথাও কোথাও টিকার সংকট রয়েছে । কিন্তু এ সংকট সাধারণ কার্যক্রমে খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি করেনি । কোনো এলাকায় সংকট দেখামাত্রই সেখানে টিকা পাঠানো হচ্ছে ।

স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা . মো . সায়েদুর রহমানও স্বাস্থ্য কার্যক্রম ওপি থেকে রাজস্ব খাতে আনার কারণে সাময়িক সমস্যার বিষয়টি উল্লেখ করেন । তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন , শিগগির এর সমাধান হবে । বিশেষ সহকারী জানান , গত অর্থবছরে টিকার জন্য সাড়ে চার শ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল । চলতি অর্থবছরে তা ১ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে । টিকা কেনার জন্য অর্থের অনুমোদন হয়েছে । দু - এক সপ্তাহের মধ্যে টিকা হাতে আসবে । ডা . মো . সায়েদুর রহমান আরও বলেন , ‘ টিকা এখন হাতে নেই , এমনটি নয় । কিছু ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে কয়েকটি কেন্দ্রে টিকা পাওয়া যাচ্ছে না । ১০-১২টি উপজেলায় এবং ৪ টি জেলায় সাময়িক ঘাটতি হয়েছে , যা ইতিমধ্যে সমাধান করা হয়েছে । আমাদের হাতে থাকা মজুত দিয়ে কার্যক্রম চলছে । '