Image description
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি » বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি হামলার পর মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা ভয়ে আছেন । » অপরাধের বিষয়ে খবর পেলেও তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়া নিয়ে দোটানায় থাকে পুলিশ । » মনোবল ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে : আইজিপি

মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যের অনেকে গত বছরের ৫ আগস্টের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি । এর মধ্যে নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে , তা হলো ভয় । সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা এই ভয় সৃষ্টি করছে । ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মনে অসন্তোষ থাকলেও মাঠে পুরো সক্রিয় হচ্ছে না পুলিশ ।

পুলিশ সূত্র বলছে , সাধারণ মানুষ এখন আর পুলিশকে মানে না , পুলিশের কথা শোনে না । হাতে অস্ত্র থাকলেও ব্যবহার নিয়ে রয়েছে জটিলতা । তাই অপরাধী বা অপরাধের তথ্য পেলেও অভিযানে যেতে আগে - পরে অনেক ভাবতে হচ্ছে । পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করছে অপরাধীরা । এটি মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে । ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ১৫ সেপ্টেম্বর ‘ লংমার্চ টু ভাঙ্গা ’ কর্মসূচিতে মহাসড়কে লাঠি হাতে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী অল্পসংখ্যক পুলিশকে ধাওয়া করে । পুলিশ সদস্যরা আশ্রয় নেন ভাঙ্গা মডেল মসজিদে । তাঁদের অনেকের তখন গত বছরের ৫ আগস্টের কথা মনে পড়েছিল । ছাত্র - জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে থানা - ফাঁড়ি , পুলিশসহ অসংখ্য স্থাপনায় হামলা , ভাঙচুর , অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্র - গোলাবারুদ লুটপাট করা হয় । এতে সব থানার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় । কর্মবিরতি শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা ।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী , ওই সময় সারা দেশে ৪৩ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন । অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা শুরু হয় । পুলিশ আবার দায়িত্বে ফেরে । কিন্তু এক বছর পরও মাঠের পুলিশ সদস্যদের ভয় কাটেনি । ১৫ সেপ্টেম্বর ভাঙ্গায় বিক্ষোভকারীদের ধাওয়ায় মসজিদে আশ্রয় নেওয়া পুলিশের এক এএসআই বলেন , ‘ এভাবে বারবার বিপদের মুখে পড়তে হচ্ছে । মনে হয় এই চাকরি আর করা যাবে না ।

'ঢাকা মহানগর পুলিশের ( ডিএমপি ) গুলশান বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন , মানুষ এখন পুলিশের কথা শুনছে না । অপরাধের তথ্য পেলেও তাঁরা ভয়ে অভিযানে যান না । সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিতে হয় । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রমনা জোনের পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন , সাধারণ মানুষ এখন পুলিশকে আর মানছে না । তাই কোনো ধরনের অপরাধের তথ্য পেলেও নিজ উদ্যোগে তাঁরা অভিযানে যাচ্ছেন না ।

জানতে চাইলে আইজি বাহারুল আলম পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এমন অবস্থার বিষয়টি স্বীকার করেন । তিনি বলেন , পুলিশের মনোবল ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে । তবে এটাও ঠিক , মাঠের বাস্তবতায় কোথাও কোথাও পরিবেশ এখনো ঠিক হয়নি । পুলিশের সূত্র জানায় , অভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হওয়ায় পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে । রাজধানীতে পুলিশের ওপর অপরাধীদের হামলার ঘটনা ঘটেছে ১ সেপ্টেম্বর রাতে । ওই রাতে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ - এর মাধ্যমে আদাবর থানা খবর পায় , শ্যামলী হাউজিং এলাকায় এক যুবককে আটকে রাখা হয়েছে । পুলিশের চার সদস্যের একটি দল সেখানে গেলে ৮-১০ জন তাঁদের ওপর হামলা চালায় । এতে কনস্টেবল আল - আমিন দায়ের কোপে গুরুতর আহত হন । পুলিশ ভ্যানও ভাঙচুর করা হয় । এরপর থেকে জরুরি কলে সাড়া দেওয়া নিয়ে দোটানায় রয়েছে থানা - পুলিশ ।

ডিএমপির তেঁজগাও বিভাগের একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি ) বলেন, ' আমরা ভাবছি এসব কলে কীভাবে সাড়া দেব । চার - পাঁচজন সদস্যের প্যাট্রল টিম গেলে নিরাপত্তা কোথায় ? ” রাজধানীর বাইরেও পুলিশ দলের ওপর হামলা , অবরুদ্ধ করে রাখার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে । ঢাকা জেলা পুলিশের এক উপপরিদর্শ ( এসআই ) বলেন , শহরের কোনো এলাকায় যাওয়া একরকম সহজ । কিন্তু গ্রামে ফাঁকা এলাকায় যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ।

পুলিশের অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনে দেখা যায় , সভা - সমাবেশে দায়িত্ব পালনে আগ্রহ কমেছে প্রায় ৩২ শতাংশ সদস্যের । তাঁরা নানা অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন । এক জরিপে অংশ নেওয়া ৯৮ শতাংশ পুলিশ সদস্য জানান , তাঁরা মানসিক চাপে আছেন । ৯৫ শতাংশ মনে করেন , নিয়মিত কাউন্সেলিং প্রয়োজন ।

অথচ পুলিশ বাহিনীর এখনো পূর্ণাঙ্গ মানসিক স্বাস্থ্য ইউনিটই নেই । সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , গাবতলী , টঙ্গী , খুলনা ও রাজশাহীতে শান্তিপূর্ণ মিছিল হলেও সংশ্লিষ্ট থানাগুলো একা দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি । অতিরিক্ত ফোর্স ডাকতে হয়েছে । কোথাও কোথাও থানা - পুলিশ সরে দাঁড়ালে ডিবি ও র‍্যাব গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে । পুলিশ সদর দপ্তর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু প্রশিক্ষণ ও কাউন্সেলিং সেশন শুরু করেছে । কয়েকটি জেলায় চালু হয়েছে ‘ স্ট্রেস রিলিফ টক ' ও
‘ রিফ্রেশার ট্রেনিং । তবে অনেক সদস্যই এগুলোকে মনোবল ফেরানোর জন্য পর্যাপ্ত মনে করছেন না ।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার আজকের পত্রিকাকে বলেন , মনোবল ফিরিয়ে আনা ছাড়া মাঠে সক্রিয় থাকা সম্ভব নয় । কর্মঘণ্টা , সুযোগ - সুবিধা , বিশ্রাম — সবকিছু নিয়েই এখন নতুন করে ভাবতে হবে ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা . মুনতাসীর মারুফ বলেন , পুলিশের মধ্যে অনেকেই পোস্ট - ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ( পিটিএসডি ) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন । তাঁদের মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি সামাজিক ও আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে । এতে ধীরে ধীরে তাঁরা স্বাভাবিক হতে পারবেন । তাঁর মতে , পুলিশ সদস্যদের মনোবল পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব নিতে হবে পুলিশ সদর দপ্তরকেই ।