Image description

রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ৪টি সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এই প্রতিবেদন তুলে দেন সংশ্লিষ্ট কমিশন প্রধানরা। এদিন জানানো হয়েছে আরও ৬টি কমিশন প্রতিবেদন   
জমা দিতে এক মাস সময় পেয়েছে। তাদের রিপোর্ট জমা হলে ফেব্রুয়ারিতে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হবে। আলোচনার মাধ্যমে তৈরি হবে গণ- অভ্যুত্থানের সনদ। যার ভিত্তিতে হবে জাতীয় নির্বাচন। চার কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন তথ্য জানিয়ে বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্নের যাত্রা শুরু হলো।

বুধবার সকাল সাড়ে ১১টায় তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, সংবিধান এবং দুদক সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর সেখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদন জমা হওয়ার মধ্যদিয়ে নতুন অধ্যায় শুরু হলো মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এটার মাধ্যমে আমরা আলোচনা শুরু করবো সবার সঙ্গে যে, সবার মন এর মধ্যে সায় দিচ্ছে কিনা; অঙ্গীকারগুলো পূরণ হচ্ছে কিনা- সেটার আলোচনা।
আলোচনার রসদ আপনারা (সংস্কার কমিশন) তৈরি করে দিয়েছেন। সে আলোচনার পরবর্তী অধ্যায়টা কী হবে- সেটাও আমরা জেনে রাখি- একটা মতৈক্য প্রতিষ্ঠা হবে। সবাই একমত হবে না। কিছু অংশে একদম একমত হবেন। আমরা কী স্বপ্ন দেখলাম যে- একা একা স্বপ্ন দেখলাম? মানুষের স্বপ্নের অংশ নেই, সেটা তো হতে পারে না। আমরা কতোটুকু সে (গণ-অভ্যুত্থানের) স্বপ্ন নিয়ে আসছি সেটার জন্যই এই আলোচনা। এটা বাইরে থেকে চাপানো জিনিস না; ভেতর থেকে উদ্ভূত একটা জিনিস।

তিনি বলেন, যে আলোচনা হবে, সে আলোচনার নেতৃত্ব দেবেন আপনারা (সংস্কার কমিশন) মতৈক্য প্রতিষ্ঠার জন্য। যেহেতু আপনারাই তাদের পক্ষ থেকে স্বপ্ন দেখেছেন, কীভাবে তাদের স্বপ্ন আপনাদের স্বপ্ন একাকার হয়ে যাবে, তার মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থানের একটা চার্টার তৈরি হবে। এই সনদের ভিত্তিতেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, ওই যে নতুন বাংলাদেশের চার্টার, সেই চার্টারটা মতৈক্যের ভিত্তিতে হবে। নির্বাচন হবে, সবকিছু হবে; কিন্তু চার্টার হারিয়ে যাবে না। এ চার্টার থেকে যাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে। এটা আমাদের জাতীয় কমিটমেন্ট। এটা কোনো দলীয় কমিটমেন্ট না। আমরা চাচ্ছি সব দল এই চার্টারে সাইন অন করবে।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে ‘ঐতিহাসিক নোট’ বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এটা শুধু আনুষ্ঠানিকতা না, এটা একটা ঐতিহাসিক নোট। এ ঘটনাটা, ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামানসহ কমিশনগুলোর সদস্যরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

ওদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে কমিশনগুলোর দেয়া প্রতিবেদন এর সারসংক্ষেপও গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। 
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে রাষ্ট্রীয় তিনটি মূলনীতি বাদ দিয়ে পাঁচটি মূলনীতি করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশ এর পরিবর্তে ‘জনগণতন্ত্রী’ বাংলাদেশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়- এমন নানা সুপারিশ দেয়া হয়েছে এই কমিশনের রিপোর্টে। 

ওদিকে নির্বাচন সংস্কার কমিশন নির্বাচন ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দৃঢ় করার উপর জোর দিয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫০টির মতো সুপারিশ দিয়েছে কমিশন। পুলিশ সংস্কার কমিশন পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ সহ ১৫টি ক্ষেত্রে প্রস্তাবনা দিয়েছে। প্রশাসন ও আমলানির্ভরতা কমাতে সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সংষ্কার কমিশন। এই কমিশন ৪৭টি সুপারিশ পেশ করেছে।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতিতে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ ছাড়াও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দুইবারের বেশি  মেয়াদ নয়, আইনসভার মেয়াদ ৪ বছর, এনসিসি গঠন, সংবিধান সংশোধন, আন্তর্জাতিক চুক্তি, অন্তর্বর্তী সরকার, বিচার বিভাগসহ বেশকিছু বিষয়ে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। কমিশন দীর্ঘ সাড়ে ৩ মাসের পর্যালোচনা শেষে গতকাল প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের সংস্কার সুপারিশ হস্তান্তর করে। 

শুরুতে সংবিধানের প্রস্তাবনায় কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। যেখানে এই ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয় উল্লেখ আছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের গণআন্দোলনকেও গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীনতার আদর্শে ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ লড়াইয়ের উল্লেখ আছে। সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। 

নাগরিকতন্ত্রের বিষয়ে বলা হয়েছে, সংবিধানের প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘জবঢ়ঁনষরপ’ ‘চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ইধহমষধফবংয’ শব্দগুলো থাকছে। রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’। সংবিধানে বাংলাদেশে নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত সকল ভাষা এ দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। বিলুপ্তের সুপারিশ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি...’। বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) সংশোধন করে বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন। কমিশন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক এবং ৭খ বিলুপ্তির সুপারিশ করছে। পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। 
রাষ্ট্রের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেয়ার সুপারিশ করছে।

বিদ্যমান সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের অধিকারসমূহ সমন্বিত করে ‘মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা’ নামে একটি একক সনদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আদালতে বলবৎযোগ্য হবে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার ও নাগরিক, রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে বিদ্যমান তারতম্য দূর করবে। এ ছাড়া, জীবনের অধিকার রক্ষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, জামিনে মুক্তির অধিকার অন্তর্ভুক্তকরণ এবং নিবর্তনমূলক আটক সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশন একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে। একটি নিম্ন্নকক্ষ জাতীয় সংসদ এবং একটি উচ্চকক্ষ। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে ৪ বছর। নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। ৩০০ জন সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। আরও ১০০ জন নারী সদস্য সারা দেশের সকল জেলা থেকে এই মর্মে নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনী এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০% আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে। সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২ জন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যাদের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। একজন সংসদ সদস্য একইসঙ্গে নিম্নলিখিত যেকোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না: (ক) প্রধানমন্ত্রী, (খ) সংসদনেতা, এবং (গ) রাজনৈতিক দলের প্রধান। অর্থবিল ব্যতীত নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সবসময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন।

আর উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে; এর মধ্যে ১০০ জন সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (চৎড়ঢ়ড়ৎঃরড়হধষ জবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ-চজ) পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের মনোনয়ের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ জন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন আইন দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবে। অবশিষ্ট ৫টি আসন পূরণের জন্য প্রেসিডেন্ট নাগরিকদের মধ্য থেকে (যারা কোনো কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন) প্রার্থী মনোনীত করবেন। কোনো রাজনৈতিক দলকে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বের যোগ্য হতে হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের অন্তত ১% নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চকক্ষের স্পিকার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের একজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন যিনি সরকার দলীয় সদস্য ব্যতীত উচ্চকক্ষের অন্য সকল সদস্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন।

সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে, এটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটের ফলাফল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। আর আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে।
অভিশংসনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করা যাবে। নিম্ন্নকক্ষ অভিশংসন প্রস্তাবটি পাস করার পর তা উচ্চকক্ষে যাবে এবং সেখানে শুনানির মাধ্যমে অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
নির্বাহী বিভাগের কথা বলা হয়েছে, আইনসভার নিম্নকক্ষে যে সদস্যের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন আছে তিনি সরকার গঠন করবেন। নাগরিকতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা দ্বারা প্রযোগ করা হবে। কমিশন প্রেসিডেন্টের কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা সুপারিশ করছে; এই বিশেষ কার্যাবলী কিংবা সংবিধানে উল্লেখিত বিষয় ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করবেন। কমিশন রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়ন এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করছে। এনসিসি’র সদস্য হবেন: প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধিত্বকারী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের উভয় কক্ষের সদস্যরা ব্যতীত, আইনসভার উভয় কক্ষের বাকি সকল সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাদের মধ্য থেকে মনোনীত ১ জন সদস্য।

আইনসভা ভেঙে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শপথ না নেয়া পর্যন্ত বিদ্যমান এনসিসি সদস্যরা কর্মরত থাকবেন। আইনসভা না থাকাকালীন এনসিসির সদস্য হবেন- প্রেসিডেন্ট, প্রধান উপদেষ্টা, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদের দুইজন সদস্য। এনসিসি নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলগণ; সরকারি কর্ম কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার; প্রতিরক্ষা-বাহিনীসমূহের প্রধান; আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের কাছে নাম প্রেরণ করবে।
প্রেসিডেন্টের কথা বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্টের মেয়াদ হবে ৪। প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচক মণ্ডলীর (ইলেক্টোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। ইলেক্টোরাল কলেজ গঠিত হবে আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্য প্রতি একটি করে ভোট; প্রতিটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট: প্রতিটি ‘সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করা যাবে।

আর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হবেন। 
অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলা হয়েছে, আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে অথবা আইনসভা ভেঙে গেলে, পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ (পনের) সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন। মেয়াদ সর্বোচ্চ ৯০ দিন হবে, তবে যদি নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হয় তবে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শপথ গ্রহণমাত্র এই সরকারের মেয়াদের অবসান ঘটবে।
প্রধান উপদেষ্টার কথা বলা হয়েছে, আইনসভার সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে। এনসিসি’র ৯ (নয়) সদস্যের মধ্যে ন্যূনতম ৭ (সাত) সদস্যের সিদ্ধান্তে এনসিসি’র সদস্য ব্যতিত নাগরিকদের মধ্য থেকে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। অনুচ্ছেদ ৪.১ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব না হলে, সকল অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্য থেকে একজন গ্রহণযোগ্য এনসিসি’র ৯ (নয়) সদস্যের মধ্যে ন্যূনতম ৬ (ছয়) সদস্যের সিদ্ধান্তে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। উপরে উল্লিখিত অনুচ্ছেদ ৪.২ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব না হলে, এনসিসি’র সকল সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্ট প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

কমিশন প্রতিটি জেলায়, পারস্পরিক কার্যক্রমের সমন্বয়ের লক্ষ্যে একটি  ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করছে, যা সেই জেলার মধ্যে সকল এলজিআই’র জন্য একটি সমন্বয় এবং যৌথ কার্য সম্পাদনকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। এর সদস্য হবেন- প্রতিটি উপজেলা পরিষদ থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও দু’জন ভাইস চেয়ারম্যান; প্রতিটি পৌরসভা থেকে নির্বাচিত মেয়র ও দু’জন ডেপুটি মেয়র; প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব সমন্বয় কাউন্সিল থাকবে। স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করছে, যা একজন প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনার এবং ৪ (চার) জন কমিশনার নিয়ে গঠিত হবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট- কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা। সেদিক থেকে বিবেচনা করে আমরা সংবিধানের যে ধারাগুলোর, যে বিষয়গুলোর সংস্কার করা দরকার সেগুলো আমরা বলেছি। সুপারিশগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্যের আশা করে তিনি বলেন, একটা ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় আজকে আসলে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এই প্রস্তাবগুলো, সুপারিশগুলো রাখছি। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে।

নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ১৫০ সুপারিশ
নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বেশ কিছু বিষয়ে সুপারিশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। যেখানে নির্বাচন কমিশন গঠন, কমিশনের ক্ষমতা, দায়িত্ব, রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতা, মনোনয়নপত্র, নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যয়ের বিষয়ে বিষদ আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ দিয়েছে। প্রস্তাব করা হয়েছে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির। কমিশন নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, পোস্টাল ভোটের বিষয়ে তাদের মত দিয়েছে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ তুলে দেন এর সদস্যরা। 

নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল এবং পুনঃনির্বাচনের ক্ষমতা প্রদান করা; নির্বাচন কমিশনের সচিব নিয়োগের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা; নির্বাচনকালীন নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে নির্বাহী বিভাগের পক্ষ থেকে এমন কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নেয়ার বিধান করা; ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের মতো বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, লিখিতভাবে যুক্তিসঙ্গত কারণ প্রদর্শনপূর্বক, সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, ৯০ দিনের অন্য নির্বাচন স্থগিত করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে প্রদানের জন্য প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে মতামত চাওয়ার বিধান করা।

নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, ফলাফল গেজেটে প্রকাশের পূর্বে, নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ঘোষণা প্রদানের বিধান করা; নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো রাজনৈতিক দল সংক্ষুব্ধ হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অভিযোগ করার সুযোগ সৃষ্টির বিধান করা। কমিশন/আদালত কর্তৃক সর্বোচ্চ ৭ কার্যদিবসের মধ্যে উক্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি করার বিধান করা; স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুরো দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত করা; ভোটার শিক্ষা ও সচেতনতা এবং গবেষণা কার্যক্রমকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। এসব কার্যক্রমে শিক্ষার্থী ও বেসরকারি সংস্থার সহায়তা গ্রহণ করা; নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ‘ভোটার-প্রার্থী মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা; কমিশন কর্তৃক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী ও পোলিং এজেন্টদের সুরক্ষা প্রদানের বিধান করা; আউয়াল কমিশন ২০২৩ সালে যেসব বিতর্কিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন প্রদান করেছে, যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করা।

প্রার্থী কর্তৃক মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রত্যেক দল তার প্রার্থীদের জন্য প্রত্যয়নপত্রের পরিবর্তে দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক বা অনুরূপ পদধারী ব্যক্তি কর্তৃক হলফনামা জমা দেয়ার বিধান করা, পরবর্তী নির্বাচনের আগে যে কোনো সময় নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত ব্যক্তির হলফনামা যাচাই-বাছাই করতে এবং মিথ্যা তথ্য বা গোপন তথ্য পেলে তার নির্ধারণ বাতিল করা।

নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিধান বাতিল করা; নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা; কোনো আসনে মোট ভোটারের ৪০% ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন অনুষ্ঠান করা; বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বন্ধ করা, রাজনৈতিক দলগুলোকে সৎ, যোগ্য এবং ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনে ‘না-ভোট’র বিধান প্রবর্তন করা। নির্বাচনে না-ভোট বিজয়ী হলে সেই নির্বাচন বাতিল করা এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাতিলকৃত নির্বাচনের কোনো প্রার্থী নতুন নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারার বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে।

সংসদীয় আসনের ভোটার প্রতি ১০ টাকা হিসেবে নির্বাচনী ব্যয় নির্ধারণের বিধান করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ/গণমাধ্যমকে নিশ্চল পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়া, যাতে পর্যবেক্ষকরা সারাদিন কেন্দ্রে থাকতে পারে, কিন্তু ভোটকক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে নয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাকে প্রাক্‌-নির্বাচনকালীন পর্যবেক্ষণের অফিসিয়াল অনুমতি প্রদান করার সুপারিশ করা হয়েছে। 
সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই টার্মে সীমিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের অযোগ্য করা এবং একই ব্যক্তি একইসঙ্গে যাতে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হতে না পারেন তার বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে। 

সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১০০ আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে (সংখ্যানুপাতিকভাবে) আসন বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। উচ্চ কক্ষে প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত আসনের ৫০% দলের সদস্যদের মধ্য থেকে এবং অবশিষ্ট ৫০% আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ইত্যাদির মধ্য থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত করার বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে। কমপক্ষে ৩০টি নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা এবং সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্যদের বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে স্নাতক নির্ধারণ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকারের পদ দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সংসদের (নিম্নকক্ষ) আসন সংখ্যা ১০০ বাড়িয়ে মোট সংখ্যা ৪০০ করা। এই ৪০০ আসনের মধ্যে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০০ আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিধান করা, যাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট আসন থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বন্ধ হয়।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলনিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বিধান করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। 
কার্যকর সংসদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংসদ সদস্যদের প্রত্যাহারের বিধান করা; সংসদ সদস্যদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে। 
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে মেয়াদ চারমাস নির্ধারিত করে এবং এ মেয়াদকালে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের নাম অন্য ২০ জন উপদেষ্টাকে নিয়োগের বিধান করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
স্থায়ী ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠন করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে। 

সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রত্নবিদ আইন অনুযায়ী সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা। ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন ২০২৩ যার মাধ্যমে এনআইডি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে জরুরি ভিত্তিতে বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রবাসীদের ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণে বেশ কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণে সুপারিশ ছিল সংস্কার কমিশনের। প্রবাসী পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থায় বলা হয়েছে, প্রবাসীদের জন্য একটি তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তাসূচক পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থার প্রস্তাব করছি, যার মাধ্যমে প্রবাসীদের পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবিত তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তাসূচক পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থার বাস্তবায়নকল্পে দুইটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ভোটার অ্যাপ এবং ভেরিফায়ার অ্যাপ যথাযথ ফাংশনালিটিসহ ডেভেলপ করা। 
অনলাইন ভোটিং ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু প্রস্তাব রেখেছে সংস্কার কমিশন। 
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা একটা গুরু দায়িত্ব। নির্বাচন ব্যবস্থা ‘ভেঙে’ গিয়েছে, এটাকে জোড়া লাগানোর জন্য এই সংস্কার কমিশনের প্রচেষ্টা। কাজটি করতে গিয়ে তিনি উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ছিলেন এবং সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে। আমরা কতোগুলো প্রস্তাব করেছি- যেগুলো পরিস্থিতিটাকে আরও উত্তপ্ত করতে সহায়তা করবে। নির্বাচন ব্যবস্থায় যাতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয় সে চেষ্টাই করার কথা তুলে ধরেছেন তিনি।

আমলানির্ভরতা কমিয়ে দুদক শক্তিশালী করতে ৪৭ দফা
রাজনীতি ও আমলানির্ভরতা কমিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে শক্তিশালী করতে ৪৭ দফা সুপারিশ দিয়েছে দুদক সংস্কার কমিশন। দীর্ঘ তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা কমিশন গতকাল প্রধান উপদেষ্টার হাতে প্রতিবেদন তুলে দেন। পরে বিকালে দুদক সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ড. ইফতেখারুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ সময় কমিশনের অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। 

ইফতেখারুজ্জামান জানান, প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। কমিশনকে কার্যকর ও গতিশীল করতে তিন সদস্যের কমিশন দুদকের কাজের জন্য যথেষ্ট মনে করছে না সংস্কার কমিশন। তাই তিন সদস্যের পরিবর্তে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠনের সুপারিশ দেয়া হয়েছে। পাঁচ সদস্যের কমিশনে একজন নারী সদস্য যুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে দুদকের কাজের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এমন বিচারিক ও ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো অভিজ্ঞদের যুক্ত করা এবং কমিশনের মেয়াদ পাঁচ থেকে কমিয়ে চার বছর করার সুপারিশ করা হবে।

কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি: কমিশন গঠনে যে দুদক আইনে সার্চ কমিটির কথা বলা রয়েছে, সেটি পরিবর্তন করে ‘বাছাই ও পর্যবেক্ষক কমিটি’ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই কমিটি কমিশন বাছাই করে দেবে, সেই সঙ্গে কমিশন কী ডেলিভারি করছে তা ছয় মাস পর পর পর্যবেক্ষণ করবে। এটার জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিও প্রতিবেদনে সুপারিশ আকারে দিয়েছেন তারা।
কমিশন গঠনে বিতর্কিত ‘সার্চ’ কমিটি ও দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনা এড়াতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বাদ দিয়ে তার পরে যিনি সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ হবেন, তিনি হবেন বাছাই কমিটির প্রধান, হাইকোর্টের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ একজন সদস্য হবেন, একজন থাকবেন প্রধান বিচারপতির নিযুক্ত একজন- যিনি বাংলাদেশের শাসন সম্পর্কে জানেন, মহাহিসাব নিরীক্ষক, পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে একজন, সংসদ নেতা থেকে মনোনীত একজন সদস্য ও প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা থেকে মনোনীত একজন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে বাছাই কমিটি।

কমিশন গঠনের বিষয়টি এতদিন গোপন থাকলেও এবার এটা সবার জন্য উন্মুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সংস্কার কমিশন তিনটি পদ্ধতির কথা সুপারিশ করেছে, একটি হলো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ‘শর্ত পূরণ’ সাপেক্ষে যে কেউ চাইলে কমিশনার হতে আবেদন করতে পারবেন বা ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, ‘বাছাই ও পর্যবেক্ষক’ কমিটি চাইলে বাছাই করে প্রার্থীর তালিকা তৈরি করতে পারবে। তৃতীয় হলো- কেউ চাইলে প্রার্থী মনোনীত করতে পারবেন।

প্রত্যেক প্রার্থীকে জীবনবৃত্তান্ত, পাশাপাশি দুদক সম্পর্কে তার জানাশোনা ও চিন্তাভাবনা কী, দুদক সম্পর্কে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানা, প্রাথমিকভাবে তাদের তালিকা করা-এভাবে মিনিমাম কোয়ালিটি যারা মিট করবেন, তাদের শর্ট লিস্টে তালিকাভুক্তদের ইন্টারভিউ করার জন্য ডাকা হবে।

প্রাথমিক তালিকা থেকে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে তিনজন করে ১৫ জন বাছাই করবে কমিটি। পরে এই নামগুলো এক সপ্তাহের জন্য পাবলিক করে দেয়া হবে। এক সপ্তাহ পর সেই তালিকা থেকে ১০ জনকে বাছাই করা হবে। রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের তালিকা দেবে। তবে সেই ১০ জনের নাম আর প্রকাশ করবে না। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে নিয়োগ দেবেন।

চাকরিবিধিতে যে সংস্কার: দুদকের বিতর্কিত চাকরিবিধি ৫৪-এর ২ ধারা বাতিল, সচিব পদ থেকে নিচের দিকের পদগুলোতে নিয়োগ-পদায়নে কমিশনের আইনের বড় পরিবর্তন এনে সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে সচিব নিয়োগ, মহাপরিচালক পদে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা থেকে ৬০ শতাংশ পদায়ন ও পদোন্নতি, পরিচালক পদে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা ৭৫ শতাংশ করার সুপারিশ তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের চাকরি থেকে অপসারণ করারও সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রসিকিউশন গঠন: দুদক আইনে স্বাধীন প্রসিকিউশনের কথা বলা থাকলেও সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার দুই দশকে প্রসিকিউশনই গঠন করা হয়নি। সংস্কার কমিশন একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে, এতে ১০ থেকে ২০ শতাংশ নিজস্ব কর্মীর মাধ্যমে প্রসিকিউশনের যাত্রা শুরু করবে। পরে ক্রমান্বয়ে তা বাড়িয়ে নিজস্ব প্রসিকিউশন টিম গঠন করা হবে। একইভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি অনুসন্ধানের যে পূর্বানুমতির বিধান করা হয়েছিল, সেটি পুরোপুরি বিলুপ্তি করার বিষয়টি প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।

কমিশনের কাজের পরিধি বাড়াতে চলমান ৩৬ জেলা কার্যালয়ের পরিবর্তে প্রতিটি জেলায় দুদকের কার্যালয় চালু করতে হবে। এখন যে জেলা কার্যালয়গুলো আছ


author

Ari budin

#

Programmer, Father, Husband, I design and develop Bootstrap template, founder