সম্প্রতি একশ পণ্যের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর কারণে অন্তর্বর্তী সরকার চার ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করে সতর্ক করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ঝুঁকিগুলো হচ্ছে-মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে এবং এতে সাধারণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে; যা কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। এছাড়া ভ্যাট বৃদ্ধির সুযোগকে পুঁজি করবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তারা পণ্য ও সেবায় অতিরিক্ত মূল্য বাড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থাটির এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন উপদেষ্টার কাছে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, এর বিশ্লেষণ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এর আগে প্রথমবার ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। সংগঠনের সভাপতি তাসকিন আহমেদ শিল্পের শুল্ক বাড়ানো আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যাওয়া বলে মন্তব্য করেছেন। একে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে দ্রুত প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী যুগান্তরকে জানান, নানা নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়ার পরও গত দুই বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। শিগ্গিরই কমবে বলে মনে হচ্ছে না। এর মধ্যে একশ পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। মূলত আইএমএফ-এর শর্ত পালন করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর প্রভাব বাজারে পড়ছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করে বিকল্প পথে আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে পারলে ভালো হতো, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি ফলপ্রসূ হতো।
প্রসঙ্গত, ৯ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ওই নির্দেশনার ভিত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ৭ দশমিক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক ১০০ শতাংশ পর্যন্ত আরোপ করেছে। যদিও ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৯২ এবং সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে বিরাজ করছে।
ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, সেটি নিয়ে পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করে গোয়েন্দা সংস্থাটি। সেখানে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর যুক্তি হিসাবে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি, এসডিজি বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক সমতার লক্ষ্যকে দেখানো হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ডিসেম্বরে ঢাকায় সফরকালে এনবিআর-এর সঙ্গে বৈঠকে আগামী দিনে কর অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে আনার চাপ দেয়। পাশাপাশি কর জিডিপির অনুপাত আগের ০.৫ শতাংশ বৃদ্ধির সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত জুড়ে দেয় আইএমএফ, যা টাকার অঙ্কে বাড়তি রাজস্ব আহরণ করতে হবে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এখন আরও অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে। ফলে আইএমএফ-এর বাড়তি রাজস্ব আহরণের শর্ত পূরণ করতে ভ্যাট বাড়ানোর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা, যা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানো এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখতে ইতোমধ্যে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, ডিম ও খেজুরের ওপর আমদানি, স্থানীয় ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর ছাড় দেওয়া হয়। এতে রাজস্ব আদায় ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। এ রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে নতুন করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ওষুধ, পোশাক, হোটেল-রেস্তোরাঁ, সাবান ও ডিটারজেন্ট, মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, এলপিজি ও ফলমূল-এসবের ওপর সহনীয় মাত্রায় কর আরোপ করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া করদাতার হয়রানি বন্ধে রাজস্ব আদায়ের পুরো প্রক্রিয়া (পেপারাইজড সিস্টেম) সফটওয়ারভিত্তিক ও অটোমেশন করা এবং যোগ্য সব প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করা। জানা যায়, বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধন রয়েছে ৫ লাখ ২৫ প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে ৩ লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দেয়।
পাশাপাশি অসাধু রাজস্ব কর্মকর্তাদের অনিয়মসহ কাস্টম হাউজগুলোর অনিয়ম বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা, আইএমএফ শর্তগুলোর ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া। সুপারিশে আরও বলা হয়, পণ্য আমদানিতে অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণা, একই পণ্যের একাধিক চালান প্রস্তুতকরণসহ কাস্টম হাউজগুলোয় অনিয়ম বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয় আইএমএফ। এ ঋণের তিন কিস্তির টাকা ইতোমধ্যেই ছাড় করা হয়েছে এবং চতুর্থ কিস্তির টাকাও দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু এরই মধ্যে আইএমএফ-এর কাছ থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আরও এক বিলিয়ন ডলার সহায়তা চাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, আইএমএফ-এর সঙ্গে আলোচনার সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দরকষাকষিতে অদক্ষতার কারণেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হয়েছে। তবে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এভাবে ভ্যাট আরোপ করা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ। ভ্যাট বাড়ানোর কারণে দরিদ্র, নিুমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বাজারে বিরূপ প্রভাব : রাজধানীর নয়াবাজারে ফল কিনতে আসা আল আমিন বলেন, তিনদিন আগেই প্রতি কেজি আনার ৫০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। আজ ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মালটার কেজি ২৮০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে ২৩০-২৫০ টাকা ছিল। ছেলে-মেয়েদের জন্য মাঝেমধ্যে ফল কিনতে হয়। এখন আর কিনতে পারব না। লক্ষ্মীবাজারের একটি রেস্তোরাঁয় কথা হয় হাকিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, তিনদিন আগেও একটি বার্গার ১২০ টাকায় কিনেছি। এখন সেই একই পণ্য ১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীরা কলেজ শেষে এখানে খাওয়াদাওয়া করি। এভাবে দাম বেড়ে গেলে আমাদের ব্যয় বাড়বে।