ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এই লুটপাটের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এসকে) সুর চৌধুরী। নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের পদে থেকেও তিনি লুটপাটকারীদের আইনের আওতায় আনেননি। উলটো তাদের লুটপাট করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সময়ে সময়ে নীতিমালা করা ছাড়াও দিয়েছেন সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক-প্রতিষ্ঠান দখলের মতো গুরুতর অপরাধকে বৈধতা দিয়েছেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী পরিদর্শন ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করতে অন্যতম সহায়কের ভূমিকা পালন করেন এই ব্যাংকখেকো। তার অন্যতম সৃষ্টি আলোচিত পিকে হাদলার। আর এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ‘কৌশলী সহায়তাকারী’ হিসাবে নিয়েছেন অঢেল সুবিধা। যার বেশিরভাগ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্পদ বিবরণী না দেওয়ার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মঙ্গলবার এসকে সুর চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেলখানায় পাঠানো হয়। এদিকে তার গ্রেফতারের খবরে বর্তমান ও সাবেক ব্যাংকাররা যুগান্তরের কাছে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল পদে থেকে তিনি নির্বিঘ্নে নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতি করে গেছেন। তার আমলেও বেশিরভাগ ঋণ ছাড় ও লুটপাট হয়েছে। ব্যাংক খাত ধ্বংসের শুরুটা হয় তার হাত দিয়েই। যদিও তিনি কখনো গভর্নর ছিলেন না। কিন্তু অলিখিতভাবে গভর্নরের ভূমিকায় ছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হলেও মূলত ব্যাংক চালাতেন এসকে সুর চৌধুরী। একটি বেসরকরি ব্যাংকের সাবেক এমডি ও সিনিয়র ব্যাংকার যুগান্তরকে বলেন, ‘এতদিন পর একটা বড় মাছ ধরা পড়ল। যদিও তাকে অনেক আগে গ্রেফতার করা উচিত ছিল। এই ‘সুর’ পুরো আর্থিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান থাকলেও মূলত ব্যাংক চালাতেন তিনি। এজন্য আতিউর রহমানও এসব অপকর্মের দায় এড়াতে পারবেন না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন ডেপুটি গভর্নর নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এসকে সুর চৌধুরী ছিলেন খুবই বেপরোয়া। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরির বাইরে দেশি-বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারবেন না। কিন্তু এসকে সুর চৌধুরী চাকরি জীবনের শুরুতেই সহকারী পরিচালক থাকাবস্থায় ঢাকায় একটি বিদেশি দূতাবাসের অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন। এ অপরাধে তাকে চাকরিচ্যুত করার বিধান থাকলেও রহস্যজনক কারণে লঘু শাস্তি হিসাবে সিলেট শাখায় বদলি করা হয়। এরপর থেকেই ছোটখাটো অনিয়ম করা তার কাছে রুটিনওয়ার্কে পরিণত হয়। তবে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসে মহাব্যবস্থাপক হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে যুক্ত হন। তখন তিনি এস আলমসহ বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।
জানা গেছে, এসকে সুর চৌধুরী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। এর মধ্যে একটি বিভাগ হচ্ছে অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ। এই বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক থাকার সময়ে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংককে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কৃষি ঋণ বিতরণ বিভাগে থাকার সময় এবং নির্বাহী পরিচালক হওয়ার পরও বিভিন্ন শিল্প গ্রুপকে বেআইনি সুবিধা দিয়েছেন। নির্বাহী পরিচালক থাকার সময় তিনি কিছুদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসের দায়িত্বে ছিলেন। ওই সময়ে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোকে বেআইনি সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের অনিয়ম শনাক্তে শিথিলতা দেখিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো আড়ালও করেছেন। এভাবে নিজে লাভবান হয়েছেন। চট্টগ্রাম এলাকার ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো ব্যাংক খাতে যে লুটপাট করেছে সে ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অন্যতম সহযোগী। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ, নূরজাহান গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রুপের ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এসকে সুরকে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই সময় থেকে তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এর ফলে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে আলোচিত ঋণ জালিয়াতি হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনাও সে সময় সামনে আসে। এতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এরপরই ধরা পড়ে বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি। এতে লুট করা হয় ৫ হাজার কোটি টাকা। এক সময়ের ভালো ব্যাংক হিসাবে পরিচিত বেসিক ব্যাংক লুটপাটের কারণে এখন খুঁড়িয়ে চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আইন-কানুন প্রয়োগের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে এসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুধবার যুগান্তরকে বলেন, এসকে সুর চৌধুরী আপদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। তবে তিনি দুর্নীতি করতেন খুব কৌশলে। কোনো প্রমাণ রাখতেন না। তাকে খুশি না করলে কোনো কাজ করা যেত না। তাই বাধ্য হয়ে ব্যাংকার-ব্যবসায়ী সবাই তাকে খুশি করতেন। ব্যাংকের পক্ষ থেকে অনেক উপঢৌকন দিয়েছি।
জানা গেছে, ওই সময়ে কোনো ব্যবসায়ীকে কি ধরনের সুবিধা দিতে হবে তার একটি তালিকাও তিনি রাখতেন। এর মধ্যে এস আলম ও বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামি প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ছিল তালিকার শীর্ষে। ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যাতে কোনো তদন্ত করা না হয় সেটি নিশ্চিত করতেন তিনি। এভাবে বড় বড় কোম্পানিগুলো থেকে সুবিধা নিতেন বড় অঙ্কের।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ২০১৫ সালে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে প্রথম নীতিমালা করার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা ছিল এসকে সুর চৌধুরীর। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের সালমান এফ রহমানের পরামর্শে তিনি ওই নীতিমালা করেন। এ নীতিমালার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ২ শতাংশ সুদে নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। এতে ঋণখেলাপিরা লাভবান হলেও ক্ষতির মুখে পড়ে ব্যাংক খাত। সেই ধারাবাহিকতায় একই ধরনের নীতিমালা আরও একাধিকবার করা হয়েছে। যে কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কমে গেছে। ফলে আয় কমেছে ব্যাংকের।
তিনি তার উপরের কর্মকর্তাদের কোনোরকম পরোয়া করতেন না। নিজের মতো করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনা করতেন। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার পরও রাজনৈতিক প্রভাবে ডেপুটি গভর্নর পদে তার মেয়াদ বাড়ানো হয় তিন দফায়। ৬২ বছরের বয়সসীমা শেষ হলে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এসকে সুর চৌধুরী ওই পদ থেকে অবসরে যান। এরপরও তাকে আরও ২ বছরের জন্য ব্যাংক সংস্কার উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তথা অলিগার্কের চাপেই এ নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এ সময়ে তিনি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান উভয় খাতেরই দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ছিলেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাটের অন্যতম নায়ক পিকে হালদারের সহযোগী। তার অনুমোদনে একের পর এক চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেন পিকে হালদার। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের শেয়ার নামে-বেনামে কিনে ওইসব প্রতিষ্ঠানে নিজেদের লোক বসিয়ে লুটপাট করেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পিকে হালদার চক্র ৫ হাজার কোটি টাকা লুট করেন। তার সঙ্গে ব্যাংক লুটের আরেক নায়ক এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদেরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক থেকে পিকে হালদারের টাকা আত্মসাতের ক্ষেত্রেও সুর চৌধুরী নীরব ভূমিকায় ছিলেন।
২০১৬ সালে ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক যখন এস আলম গ্রুপ দখল করে, সেই অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখেন সুর চৌধুরী। কারা এসব ব্যাংক দখল করল, টাকার উৎস কী ছিল, তার কিছুই তখন খতিয়ে দেখেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পিকে হালদারের জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ‘পিকে হালদারের ক্ষমতার উৎস ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। পিকে হালদার বিভিন্ন সময় আর্থিক সুবিধা ও মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের ওই দুই কর্মকর্তাকে বশে রেখে দুর্নীতির মাধ্যমে অবাধে অর্থ লোপাট করেছেন।’
আরও একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, অনিয়ম চাপা দিতে প্রতি মাসে সুর চৌধুরীসহ আরও কয়েকজনকে নগদ টাকায় ঘুস দেওয়া হতো।
একটি ব্যাংকের পর্ষদের চেয়ারম্যান যুগান্তরকে জানান, এসকে সুর চৌধুরী সব সময় প্রভাব বিস্তার করতেন। তার জানাশোনা কিংবা দক্ষতার কোনো অভাব ছিল না। তবে তার দক্ষতাকে তিনি ভালো কাজে ব্যবহার করেননি। বরং ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে এসকে সুর এতটা প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার ভয়ে কেউ কথা বলতে পারতেন না। এ সুযোগে প্রভাবশালীদের নিজের করায়ত্তে রেখে বড় অঙ্কের ঘুস লেনদেন করতেন। সুবিধামতো এসব ঘুস-দুর্নীতির টাকা সিন্ডিকেটের মধ্যে ভাগাভাগি হতো।