Image description

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ তৎপর। নির্বাচনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন, জুলাই ও সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমও জোরদার করেছে দলটি। প্রাথমিকভাবে সব আসনে দলীয় প্রার্থী দিয়ে বেশ আগে থেকেই নির্বাচনি গণসংযোগ চালাচ্ছে জামায়াত। একইসঙ্গে আগামীতে সরকার গঠনের প্রত্যাশা নিয়ে ইসলামী ও সমমনা বেশকিছু দলের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে ভোট করারও টার্গেট রয়েছে তাদের। এরই অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ, দফায় দফায় মিটিং করছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।

জানা গেছে, এখন পর্যন্ত নির্বাচনি জোটের রূপরেখা বা সমঝোতার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। তবে জুলাই সনদের আইনিভিত্তি এবং সে অনুযায়ী আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে একমত হয়েছে অন্তত আটটি দল। প্রয়োজনে এই ইস্যুতে শিগগির এক প্ল্যাটফর্ম অথবা যুগপৎভাবে কর্মসূচি দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

অবশ্য একটি নির্বাচনি জোট বা সমঝোতার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও বেশ আশাবাদী জামায়াতসহ পাঁচটি ইসলামি দল। তাদের মধ্যে রয়েছে—ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন ও নেজামে ইসলাম পার্টি। এর বাইরে ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ আরো কিছু দলকে নিয়ে নির্বাচনি সমঝোতার প্রত্যাশা রয়েছে জামায়াত-সংশ্লিষ্টদের।

যদিও জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরে সব দলই আগামী নির্বাচনে কীভাবে অংশ নেবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আগামীতে ক্ষমতায় কারা যাবে, কারা বিরোধী দলে থাকবে, কোনদিকে গেলে লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে হিসাব-নিকাশ চালাচ্ছে তারা। এ বিষয়ে ডিসেম্বরের দিকে তথা নির্বাচনি তফসিলের আগে বা পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

এদিকে এবি পার্টি, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, আপ বাংলাদেশসহ মধ্যপন্থি কয়েকটি দল নিয়ে আলাদা একটি মোর্চা করার আভাস পাওয়া গেছে। এই মোর্চাই পরবর্তী সময়ে কোনো একটি বড় দল বা জোটের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতায় যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

আগামী নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা একটি নির্বাচনি জোট গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। সবার সঙ্গে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা চলছে। সবার সঙ্গে ঐকমত্য হলেই জোট গঠন হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সব ইসলামি দলের থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।’

গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘নির্বাচনি জোটের বিষয়ে এখনো কোনো রূপরেখা হয়নি। সময়মতো এটি হবে। তার আগে সংস্কার, পিআর পদ্ধতি চালু এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং সে অনুযায়ী নির্বাচনের দাবিতে আমরা আন্দোলন চালাব।’

দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানান, নির্বাচনি জোট গঠনের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে এগোচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় হচ্ছে। ইসলামি ও সমমনাদের নিয়ে এই জোট হবে। ইসলামপন্থিদের ভোট এক বাক্সে নেওয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। নির্বাচনি তফসিল হলেই এটি চূড়ান্ত হবে।

আগামী নির্বাচন নিয়ে দলীয় অবস্থান ও জামায়াত-সংশ্লিষ্ট জোট গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমরা নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন তথা পিআর পদ্ধতির দাবি করছি। সরকার তাদের মতো অগ্রসর হচ্ছে। যৌক্তিক দাবি হিসেবে আমরা এর পক্ষে অনড় আছি। তারপরও আমরা চাই যথাসময়ে নির্বাচন হোক।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই জুলাই সনদের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন এবং সে অনুযায়ী নির্বাচন। এ বিষয়ে ৮-১০টি দলের সঙ্গে কথা হচ্ছে। এ দাবিতে আগামীতে আমরা কর্মসূচি দেব।’

জোট প্রসঙ্গে গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘ইসলামি দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতা আছে যে, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করব। বর্তমানে দুটি ঐক্য আছে; একটি হলোÑ পুরোনো পন্থায় নির্বাচন, আরেকটি হলো নতুন বাংলাদেশ ও সংস্কার যারা চায়, তাদের। মনে হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ চাওয়া দলগুলো একটি পক্ষে থাকবে।’ জামায়াতকে নিয়ে একটি নির্বাচনি জোট হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে নির্বাচনি সমঝোতা তথা আসনভিত্তিক সমঝোতা হবে। তফসিলের পরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’

গাজী আতাউর রহমান আরো বলেন, বিএনপি তো কয়েকবার ক্ষমতায় গেছে। তাদের মানুষ দেখেছে, নতুন করে আর কি দেখবে? তাই জামায়াতের নেতৃত্বে নতুন জোটের মাধ্যমে জনগণের ভোট নিয়ে তারা আগামীতে ক্ষমতায় যাবে বলেও তিনি আশা ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আমরা বৃহত্তর একটি ইসলামি জোট করার জন্য কাজ করছি। এতে বাইরের সমমনা দল আসতে চাইলে রাখা হবে।’ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করার কোনো চিন্তা এখন পর্যন্ত নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও এর ভিত্তিতে নির্বাচন হতে হবে। এই দাবিতে আমরা ইসলামি ও সমমনা ৮-১০টি দল মাঠে নামার চিন্তা করছি। ঐক্যবদ্ধ বা যুগপৎভাবে এ সরকারের কাছে কিছু দাবি জানানো হবে। তবে সরকার যদি দাবি পূরণে গড়িমসি করে, তাহলে পরবর্তীকালে কর্মসূচি দেওয়া হবে। এই দলগুলো নিয়েই পরবর্তী সময়ে নির্বাচনি জোট রূপ নিতে পারে।’

খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক আব্দুল জলিল বলেন, ‘আমরা ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক একটি জোট গঠনের বিষয়ে আশাবাদী। আমরা চাই জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন হবে। সে ক্ষেত্রে আরো অনেক দল এ বিষয়ে একমত। সবাই মিলে অভিন্ন কর্মসূচি দিতে পারে।’ তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা জোটের বিষয়টি তফসিল ঘোষণার আগে বা পরে চূড়ান্ত হতে পারে বলে তিনি জানান।

দলীয়ভাবে প্রায় ১০০ আসনে প্রার্থী ঠিক করে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, ‘আমরা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ বিষয়ে ইসলামি ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা এবং বৈঠক হচ্ছে।’ তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থিদের যেন একক প্রার্থী থাকে, সে প্রত্যাশা দেশবাসীর। জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামি দলগুলোর ঐক্য হতে পারে বলে আভাস দেন তিনি।

জানা গেছে, এবি পার্টি মধ্যপন্থি কিছু দলকে নিয়ে একটি মোর্চা করতে চাচ্ছে। এ বিষয়ে এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, আপ বাংলাদেশসহ আরো কিছু দলের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হচ্ছে। পরে সেই মোর্চা নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তফসিলের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এর আগে সবাই লাভ-লোকসানসহ নানা হিসাব-নিকাশ কষছে। জামায়াতও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

এ বিষয়ে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল বলেন, ‘আমরা আপাতত নতুন জোটকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। এটি না হলে বিএনপির সঙ্গেও নির্বাচনে যেতে পারি। তবে বিএনপি যদি ‘জিয়া’র (জিয়াউর রহমান) ধারা বাদ দিয়ে ‘মুজিব ধারা’য় চলে, তাহলে তাদের সঙ্গে যাব না।’ জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি জোটে যাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু ধর্মভিত্তিক জোটে আমরা থাকব না। আর জামায়াত নেতৃত্বের জোটেও নয়, এনসিপিসহ অন্য দলের নেতৃত্বে যদি জোট হয়, সেখানে জামায়াত থাকলেও যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বেশি সংকট হলে স্বতন্ত্রভাবেই নির্বাচন করব। তবে এসব বিষয়ে ডিসেম্বরের আগে কোনো সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে হয় না।’

নতুন মোর্চার বিষয়টি জানিয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. আতিক মুজাহিদ বলেন, ‘গণঅধিকার পরিষদ, আপ বাংলাদেশ, গণসংহতিসহ কয়েকটি দল মিলে আমরা একটি মোর্চা করতে চাই। তারপর নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে তাদের অনেক বিষয়ে ঐকমত্য আছে এবং তাদের প্রোগ্রামে এনসিপি যাচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত কোনো দলের সঙ্গেই জোট করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি। আর সেই ঐক্যের চূড়ান্ত রূপ নিতে পারে জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে। আমরা সংস্কার ও জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছি।’

রাশেদ খান বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের দলীয় অফিসে ২৩টি রাজনৈতিক দল নিয়ে বৈঠক করেছি। শাহবাগে ফ্যাসিবাদ নির্মূল ও নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের দাবিতে আমাদের সমাবেশে ৩৩টি দল এক মঞ্চে ছিল। এই ঐক্যটা ধরে রাখতে চাই, যাতে ফ্যাসিবাদ আর ফিরতে না পারে।’ তবে নির্বাচনের বিষয়ে তফসিলের আগে কোনো কিছু চূড়ান্ত হবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।