
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। নির্বাচনী প্রচার, প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যোবায়ের আহমদ
সমকাল : নির্বাচনী প্রচারে কোনো বাধা পাচ্ছেন কিনা?
আবিদুল ইসলাম খান: অনলাইনে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রচারণার শিকার হচ্ছি আমরা। এটা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-২– এ দুটি নিয়ে কোনোভাবেই ব্যবস্থা নিতে পারছে না কমিশন। তারা বারবার ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে, যা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডকে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। এভাবে চলতে থাকলে কোনোভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে না। একটা গোষ্ঠী ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুরো রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতে চায়। এর প্রমাণ হচ্ছে ব্যবস্থা না নেওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন যদি ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে আমরা ধরে নেব তারাও সেই প্রক্রিয়াতে আছে। বিশেষ করে টার্গেটেট মিসইনফরমেশন (ভুল তথ্য), ডিজইনফরমেশন (ভুল তথ্যের ইচ্ছাকৃত ব্যবহার) নিয়ে আমরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্রচার-প্রচারণার মাঝেও এটাকে আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, নির্বাচনকেন্দ্রিক দুয়েক দিন বড় আকারে বাজে প্রচারণার আশঙ্কা আছে আমাদের বিরুদ্ধে, যেটা মিটফোর্ডের মতো পরিকল্পিত কিছু ঘটানো।
সমকাল : জয়ী হলে কী নিয়ে শুরুতে কাজ করবেন। বিশেষত, নারীদের আবাসন সংকট নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
আবিদুল ইসলাম খান : ছাত্রছাত্রীদের আবাসন নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে কিছু হল নির্মাণের বাজেট পেয়েছে। সেগুলো যথাযথ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করা। যে শিক্ষার্থীদের বাইরে থাকার কোনো অবস্থা নেই, তাদের যে কোনো মূল্যে সাময়িকভাবে থাকার ব্যবস্থা করা, সেটা যেভাবেই হোক। অন্তত একটা টিনশেডের মাধ্যমে একটা টেবিল, একটা খাট– অন্তত মাথার ওপরে যেন একটা ছাউনি থাকে। বিজয়ী হলে এই উদ্যোগ খুবই দ্রুত নেব। একদম ইলেকশনের পরদিন। পরদিন না পারলেও পরের সপ্তাহ থেকে আবাসন সংকট নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করা শুরু করব।
সমকাল : প্রচার আছে, ছাত্রদল নির্বাচন চায় না। সাম্প্রতিক রিটের ক্ষেত্রে আপনাদের ষড়যন্ত্র আছে।
আবিদুল ইসলাম খান: একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে রিট হয়েছে। রিটের ফল সে ব্যক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে আসবে। নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াকে এই রিটের সঙ্গে যুক্ত করা মানে হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন বন্ধ করা। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করার একটি ষড়যন্ত্র ছিল।
ইতোমধ্যেই আমি বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত ছিল এই রিটে নিরপেক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করা। যিনি কোনো দলের হয়ে কাজ করবেন না। কিন্তু আমরা দেখেছি, একজন দলীয় আইনজীবীকে নিয়োগ করা হয়েছে।
এতে আমাদের সন্দেহ হয়েছে, ওই ব্যক্তিকে বাঁচানোর স্বার্থে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উত্তপ্ত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। সুতরাং সেদিন আমার ভূমিকা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন। আমাকে যতটা নম্রভদ্র কিংবা বিনয়ী হিসেবে চেনেন, সেদিন কিন্তু আমার বক্তৃতা ছিল অনেক বেশি কর্কশ। কারণ আমি দেখছিলাম, আমাদের রাষ্ট্রের ওপর আঘাত আসতে চলেছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া থামিয়ে দেওয়ার জন্য একটা অপচেষ্টা চলছে। তখন আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছি।
সমকাল : নির্বাচনে কারচুপির কোনো আশঙ্কা করছেন?
আবিদুল ইসলাম খান: এই আশঙ্কা করতে চাই না। পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আমরা এমন একটি নির্বাচন দেখতে চাই– সবার সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। পক্ষে বা বিপক্ষে ফল যা আসুক– প্রত্যেকে প্রত্যেককে নিয়ে কাজ করব। এমন একটা সুস্থ ও সুন্দর সংস্কৃতি আমরা দেখতে চাই। তাই নির্বাচন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে আপাতত কোনো চিন্তা করতে চাই না। আমরা ইতিবাচক চিন্তা করতে চাই।
সমকাল : কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা বিশেষত ছাত্রীরা আপনাকে দেখে সরে যাচ্ছেন। আসলে ঘটনাটি কী ঘটেছিল?
আবিদুল ইসলাম খান: আসল ঘটনা হচ্ছে, আমার আশপাশে মিডিয়া ছিল। এমন একটা অথবা দুটি ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া অনেক ভিডিও পাবেন, নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। মেয়েরা বলছে, বাবা আপনাকে ভোট দিতে বলেছেন। অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ অনেক ঘটনা ঘটতেছে। এগুলোকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে ওই দুই তিনটি ঘটনা টার্গেট করে অনলাইনে বাজে ক্যাম্পেইনের চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু যে দু-তিনজন সরে গেছে, সেটা আমার কারণে নয়, আশপাশের মিডিয়াগুলোকে তারা ফেস করতে চাচ্ছে না, মিডিয়ার কারণে তারা সরে গেছে।
সমকাল : গেস্টরুম, গণরুম চিরতরে বন্ধ করার একটি বিষয় আপনারা বলেছেন। এটা তো সরকার পতনের পর এমনিতেই নেই। আবার নতুন করে বলার কারণ কী?
আবিদুল ইসলাম খান: গেস্টরুম ও গণরুম এখন নেই। তবে এটা ফিরে আসবে না– এ নিশ্চয়তা সবাই চায়। প্রতিটি রাজনৈতিক, ছাত্র সংগঠনের ইশতেহারে এ বিষয়টা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির কালচার পাল্টাতে হবে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা, গবেষণা, সহশিক্ষা, রেজাল্ট নিয়ে ভাববে এবং পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নজর দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর অন্তত প্রথম ছয় মাস যেন পড়ার টেবিলের দিকে থাকে। এ জন্য আমরা কাউন্সেলিংয়ের চেষ্টা করব।
একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আরেক দিকে উদ্যান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ খারাপ হয়ে ঢোকে না। এখানে এসে কেউ খারাপ হয়, কেউ ভালো হয়। সুতরাং অসৎ সঙ্গে যেন সর্বনাশ না হয়– এই দিকটাতে ছাত্রদল গুরুত্ব আরোপ করবে। ছাত্রদল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উন্নয়ন ঘটাবে।
আমি নিজে গণরুমে নির্যাতিত হয়েছি এবং গণরুম থেকে বের হয়েছি। এর মূলোৎপাটন করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে রাজনীতিতে এসেছি। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে আমি এগোচ্ছি। আওয়ামী ফ্রেমিংয়ে আমাকে নিয়ে যাবেন, এটা ঠিক নয়। ছাত্রলীগের মধ্যে আপনি থেকেছেন এতদিন। এখন আপনি প্রোফাইল লাল করে আন্দোলনের স্টেক নিয়ে অনেক বড় সুশীল হয়ে যাচ্ছেন– এটা তো জাস্ট আমার ওপর জুলুম করার অপচেষ্টা।
সমকাল : সাড়া কেমন পাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা কী প্রত্যাশার কথা বলছেন?
আবিদুল ইসলাম খান: সাংবাদিকরা অনেকে বিরক্ত আমি সময় দিতে পারি না। আমরা প্রচারণার সময় পেয়েছি মাত্র ১৩ দিন। ১৮টি হল আছে, দীর্ঘ সময় আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে কক্ষে কক্ষে যেতে পারিনি। একটা বিশাল প্রতিবন্ধকতা ছিল। এখন ডাকসুর প্রার্থী হিসেবে প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করছি। কতটুকু পারছি, সেটা ভিন্ন কথা। সেই চেষ্টাটুকু যদি না করি, তাহলে শিক্ষার্থীরা আমাকে কেন ভোট দেবেন? তাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় দিচ্ছি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা বুকে টেনে নিচ্ছেন, গোলাপ ফুল দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন– এমন অসংখ্য ভিডিও পাবেন। সবার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছি।
সমকাল : সারাদেশে ছাত্রদলের নানা সহিংসতা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। এর প্রভাব ভোটে পড়বে বলে মনে করেন?
আবিদুল ইসলাম খান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম অভিযোগ কারও দেওয়ার সুযোগ নেই। অন্য সব সংগঠনে যারা আছেন, অধিকাংশই এ সরকার থেকে সুবিধা নিয়েছেন। বিভিন্নজন সচিবালয় এবং কোন কোন মন্ত্রণালয়ে দৌড়েছে– এটা সবাই জানে। কিন্তু ছাত্রদল বিজয়ের পরে ৬ আগস্ট থেকে মসজিদ, মন্দির ও থানা পাহারা দিয়ে রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করার জন্য রাজপথে থেকে গেছে।
গণঅভ্যুত্থানে থাকার বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রদল কোনো অনধিকার চর্চা করেনি। এটা প্রাথমিক সফলতা। ছাত্রদল যে সততা দেখিয়ে গেছে, দেশের রাজনীতির ইতিহাসে তা বিরল। সুতরাং ওই সব প্রভাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে না। আমাদের সেগুলোকে বরদাশত করার সুযোগ নেই। গোটা বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
সমকাল: ছাত্রদলের হল কমিটি নিয়ে নানা আলাপ আছে। হলে রাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের শঙ্কা আছে।
আবিদুল ইসলাম খান: আমরা বারবার বলছি, রাজনীতি নেতিবাচক কিছু নয়। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে, শুধু সংখ্যা দেখলেই হবে না। আওয়ামী রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিকে ঘৃণা করে পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলবেন? হলে নয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি চলবে– এটি যারা আজ বলছে, তারা তো বিশ্ববিদ্যালয়েও রাজনীতি চায়নি। তাই হলে রাজনীতি চাই না– এটা বলাও আরেকটা রাজনীতি।
এই যে আলী হোসেন জামায়াতের সমাবেশে গিয়েছে, শিবিরের সমর্থক সে। কিন্তু শিবির স্বীকার করছে না। গুপ্ত থাকা অবস্থায় যে কোনো অপরাধ করতে পারে। এটা ছাত্রদলের কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষে করা সম্ভব নয়। সুতরাং গুপ্ত রাজনীতি কিংবা রাজনীতি করি না– এমনটি যারা বলছে, তারাই সবচেয়ে বড় রাজনীতিটা করে। সবচেয়ে বড় নোংরামিটা করে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
সমকাল : ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে গেস্টরুম-গণরুম এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। এমনকি হল দখলে ছাত্রদলের নেতাদের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে সেই সময় গণমাধ্যমে ছবিসহ প্রতিবেদন হয়েছে। এই দুঃসহ পরিবেশ যাতে ফিরে না আসে– এ বিষয়ে কী করবেন?
আবিদুল ইসলাম খান: আপনারা ঘুরে ঘুরে খালি ওই অতীতে যাচ্ছেন। অতীতে শুধু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ইতিহাস না তো, শিবির ছিল, ছাত্রলীগ ছিল, সবার ইতিহাস ছিল। আমি বর্তমান জেনারেশনকে প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি আমার বর্তমান জেনারেশনের জন্য দায়বদ্ধ, অতীতের জন্য আমি দায়বদ্ধ না। আমি রাজনীতি করতে এসেছি আওয়ামী রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিকে ঘৃণা করে সুস্থ, সহনশীল রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এই পথে যদি আমি কোনো ভুল করি, তাহলে এর জবাব দেওয়ার জন্য সব সময় প্রস্তুত আছি। অতীতের ইতিহাস টেনে ছাত্রদলকে ফ্রেমিং করা উচিত নয়, এই জেনারেশনকে ফ্রেমিং করা উচিত নয়। কারণ, এই জেনারেশনই দীর্ঘদিনের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বলে সব সংগ্রামে এগিয়ে গেছে।