
জুলাই আন্দোলন চলাকালে ছিলেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর। ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে খরচ করেছিলেন লাখ লাখ টাকা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সেই ব্যক্তি হয়েছেন ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার বাদি। তিনি একা নন, গড়ে তুলেছেন বিশাল এক সিন্ডিকেট। যাদের কাজ সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নেয়। এই চক্রের সাথে রয়েছে মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রের সখ্যতাও।
৫ আগস্টের পর বিভিন্ন থানা ও আদালতে দায়ের হওয়া মামলা বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যারা বিরোধিতা করেছিল তারাই আবার এই আন্দোলনে নিহতদের নামে বাদি হয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁসাচ্ছেন।
গোয়েন্দা সূত্র ও ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্যমতে, দীর্ঘদিন কোরিয়ায় থাকার পর ২০০৬ সালে দেশে ফেরেন ইসমাঈল প্রধানীয়া। এরপর পশ্চিম মালিবাগের ৪১ শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কে থাকা ফরচুন শপিং মল ও অ্যাপার্টমেন্ট এ দু’টি দোকান ও একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। তিনি মার্কেট এবং অ্যাপার্টমেন্ট উভয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এরই মধ্যে নানা আর্থিক অনিয়ম ও বিভিন্ন অপকর্মের দায়ে এক বছর আগে নাসির উদ্দিন দুলাল নামে একজনকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই দুলাল আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে পুরো মার্কেটে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। হাতিয়ে নিয়েছিলেন কয়েক কোটি টাকা। তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্যাপক টাকা খরচ করেন। এই দুলাল চক্রের অন্যতম সদস্য মামলাবাজ সাইফুল বাহার ওরফে হাত কাটা বাহার।
গত ৫ আগস্টের পর চতুর দুলাল ছাত্র-জনতার পক্ষের লোক সেজে হত্যার অভিযোগ এনে ভাটরা থানায় একটি মামলা দায়ের করান। মামলায় অন্যদের সাথে আসামি করা হয় ইসমাঈল হোসেন প্রধানীয়াকে। আসামি করার সময় প্রধানীয়াকে দেখানো হয় রমনা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। প্রকৃতপক্ষে ওই সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আরমান হোসেন রিমন।
ওই মামলায় চলতি বছরের ৫ মে রাতে সিদ্ধেশ^রী মনোয়ারা হাসপাতাল সদ্য জন্ম নেয়া কন্যা সন্তান ও স্ত্রীর কাছ থেকে প্রধানীয়াকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। নবজাতক কন্যাসহ তিন সন্তান নিয়ে হাসপাতালের বেডে চরম মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন তার স্ত্রী।
বিষয়টি নিয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম। তাতে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মূলত ফরচুর শফিং মল ও অ্যাপার্টমেন্টের আর্থিক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারী, প্রতারণা জাল জালিয়াতির কারণে নাছির উদ্দিন দুলালকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরই ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের অ্যাকটিভ সদস্যদেরকে তার চক্রের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ১১জন অ্যাকটিভ সদস্যকে ২৮টি সত্য ও মিথ্যা মামলায় অন্তর্ভুক্ত করান।
সূত্র জানায়, মূলত জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী এলাকায় রিয়াজ নামে একজন নিহত হন। এই ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন রিয়াজের স্ত্রী ফারজানা। সেই মামলার নকল কাগজপত্র তুলে বাহার চক্রের সদস্যরা জাহিদুল বাদি হয়ে ভাটারা থানায় মিথ্যা মামলা দায়ের করান। ওই মিথ্যা মামলায় আসামি করা হয় ইসমাঈল হোসেন প্রধানীয়াকে। একই ঘটনায় আরো একটি মামলা করা হয় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায়। সেখানেইও রিয়াজের নাম পরিচয় ব্যবহার করা হয়। রিয়াজ হত্যার প্রকৃত মামলা তদন্ত করছে যাত্রাবাড়ী থানা। মিথ্যা মামলার বাদি জাহিদুলের বিরুদ্ধে খোঁজ নিতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, তিনি আরো ৫টি প্রতারণা মামলার আসামি। এর আগে এই বাদি জাহিদুল মেডিক্যাল প্রশ্ন ফাঁস মামলায় আলোচিত ড্রাইভার আবেদ আলীর সাথে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
জানা গেছে, সাইফুল ইসলাম ওরফে বাহার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মন্ত্রী/এমপিদের সাথে সখ্যতা রেখে নিজ বাড়ি বেগমগঞ্জ নোয়াখালী এবং রাজধানীতে ততোধিক মিথ্যা মামলার বাদি হিসেবে মামলা করেছেন। তিনি এতটাই ধূর্ত যে মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে আদালতের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাত করে ফাইল গায়েব করে দিতেও পিছপা হন না।
এদিকে ভুক্তভোগী ইসমাঈল প্রধানীয়া মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পেতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর প্রধান বরাবর লিখিত আবেদন করেন। তিনি বলেন, আমরা জানি নিরীহ মানুষকে কোনোভাবে গ্রেফতার হয়রানি করা যাবে না বলে সরকার একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ নাছির উদ্দিন দুলালের প্ররোচনায় সাইফুল ইসলাম ওরফে বাহার, জাহিদুল ইসলামসহ অন্যদের মিথ্যা মামলায় আমাকে করাভোগ করতে হলো। তিনি বলেন, আমি কোনো দিন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম না। এতে চরম আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।