Image description

দলীয় ভাবমূর্তি ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানে বিএনপি। চাঁদাবাজি, দখল, হুমকি-ধামকি, দুর্নীতি এবং অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে দলটি। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সাড়ে তিন হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের অনেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল কিংবা পতিত আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছেন। ফলে বিগত সময়ে আন্দোলন সংগ্রামের সক্রিয় ও দুর্দিনের ত্যাগী কর্মীরাও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের দায় মাথায় নিয়ে দল থেকে বহিষ্কার কিংবা সাংগঠনিক পদ হারিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ নির্দোষ দাবি করে দলের কাছে শাস্তি পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছেন। এ দিকে দলের অভ্যন্তরীণ তদন্তে অনেক ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হলেও নেতাকর্মীদের শাস্তি উঠানো হচ্ছে না। তাদের দলীয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে দেয়া হচ্ছে না।

দলটির সিনিয়র নেতারা বলছেন, যারা দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করবেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমনকি প্রয়োজনে বহিষ্কারের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেও পিছবা হবেন না।

দলীয় তথ্য বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ইতোমধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের নানা অভিযোগে সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৩,৫৩৭ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিএনপিতে এক হাজার ৯৮১ জনের মধ্যে ৮৩৩ জনই বহিষ্কার, ৫৭ জনের পদ স্থগিত। অন্যদের কারণদর্শানো নোটিশ, সতর্ক করা হয়েছে। সাংগঠনিক শাস্তি পুনর্বিবেচনা বা তুলে নেয়ার জন্য দেড় হাজারের মতো আবেদন জমা পড়েছে। ছাত্রদলের প্রায় ৪২১ জন বহিষ্কার ও ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে কারণদর্শানো নোটিশ; স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ নেতাকর্মী বহিষ্কার ও ১৫০ জন কারণদর্শানো নোটিশ পেয়েছেন। যুবদলেরও দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা বলেন, শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা নেবে এটা স্বাভাবিক। পতিত আওয়ামী লীগ ও কতিপয় রাজনৈতিক দলের নেতারা বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বিরুদ্ধে নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো অপরাধ ঘটলেই তা বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। দলটির কেন্দ্র সেসব যাচাই-বাছাইয়ের আগেই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এমনকি পান থেকে চুন খসলেই নেয়া হচ্ছে সাংগঠনিক ব্যবস্থা। ফলে ত্যাগী নেতাদের বহিষ্কার নয়তো পদ স্থগিত করা হচ্ছে। এতে তারা দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারছেন না। এ নিয়ে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

উল্লেখ্য, গত বছর ১১ আগস্ট ‘বরিশালে ১০ কোটি টাকার পুকুর ভরাটের চেষ্টা বিএনপি নেত্রী শিরিনের’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের জের ধরে বরিশাল বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের পদ স্থগিত করা হয়। অথচ ওই পুকুরটি শিরিনের দাদা ৬৫ বছর আগে কিনেছিলেন। ওয়ারিশ সূত্রে ওই পুকুরের আধা শতাংশের মালিক শিরিন। পুকুরটির প্রকৃত মূল্য ১০ কোটি টাকা নয় এবং এটি এখন ব্যবহার অনুপযোগী। তিনি পুকুর ভরাটে জড়িতও ছিলেন না বলে পরে প্রমাণিত হয়।

এ বিষয়ে বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, ৪২ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কখনো কেউ আমার প্রতি কোনো অভিযোগ তুলতে পারেনি। সংবাদটি প্রকাশের ফলে আমার রাজনৈতিক ও পারিবারিক সামাজিক ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। দলের কেউও আমার সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। আমার অনুরোধ- আপনারা সত্য ঘটনাটি তুলে ধরুন। আমি রাজনীতি করতে চাই সততার সাথে।

জানা যায়, গত ৬ জুন দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে গাজীপুর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হালিম মোল্লাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। তার বিরুদ্ধে ওই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আগে দল থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। ব্যবস্থা নেয়ার কারণও জানতে পারেননি তারা। এমনকি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাদের অন্ধকারে রেখে তড়িগড়ি এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। গাজীপুর জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, বিগত বছরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে এই জেলায় হালিম মোল্লার মতো অবদান আর কারো ছিল না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে থাকার পুরস্কার মিলেছে দলের সুদিনে বহিষ্কার। হাইব্রিড নেতাদের লবিং-তদ্বিরে কেন্দ্রীয় বিএনপি কোনো কারণ ছাড়াই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। হালিম মোল্লাকে বহিষ্কারের ঘটনায় নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকেই বলছেন, স্থানীয়দের কাছে হালিম মোল্লার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাওয়ায় তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।

এ দিকে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার ঘটনায় তড়িঘড়ি যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকিকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় যুবদল। এক দিকে ওই ঘটনায় দায় স্বীকার করে পুরো সংগঠনকে বেকায়দায় ফেলা হয় অন্য দিকে নিরপরাধ দুই নেতাকে বহিষ্কার করে তাদের রাজনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়া হয় বলে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা জানান। রজ্জব আলী পিন্টু জানান, তিনি ওই ঘটনার সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলেন না। সিসিটিভি ফুটেজসহ কোথাও তাকে দেখা যায়নি। হত্যাকারী ও হত্যার শিকার কোনো পক্ষের সাথেই তিনি জড়িত ছিলেন না। তবে স্থানীয় রাজনীতিতে তার বিপক্ষ অংশ ষড়যন্ত্র করে মামলায় তার নাম দিয়েছে। ঘটনার সত্যতা যাচাই না করেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সামান্যতম সম্পৃক্ততার খবর পাওয়া মাত্রই শক্ত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে অপরাধের সাথে জড়িত নয়, এমনটা প্রমাণিত হলে তাদেরকে সুযোগ দেয়া হবে।