
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন শুধু শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বের প্রতীক নয়, বরং জাতীয় রাজনৈতিক প্রবাহেরও একটি নির্দেশক। সময়ে সাথে সাথে গত চার দশকে এই নির্বাচনের প্রচারণা নাটকীয়ভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। একসময় যেখানে লাউডস্পিকার, দেয়াল লিখন, লিফলেট আর মিছিল ছিল প্রচারণার প্রধান ভরসা, সেখানে এখন ডিজিটাল পোস্টার, ভিডিও বার্তা, ফেসবুক লাইভ ও ইউটিউব সাক্ষাৎকারে রূপ নিয়েছে নির্বাচনী মাঠ।
ম্যানুয়াল প্রচারণার যুগ: ১৯৮০-১৯৯০
ঐতিহাসিক সংবাদপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে প্রচারণা ছিল পুরোপুরি ম্যানুয়াল। প্রার্থীরা হলে হলে লিফলেট বিতরণ করতেন, দেয়ালে স্লোগান লিখতেন, ক্লাসে গিয়ে সরাসরি প্রচারণা চালাতেন। কেউ কেউ এমনকি ভোট চাইতে শিক্ষার্থীদের বাসায়ও গিয়েছিলেন। রাতভর হলে প্রচারণা, বিকেলে মিছিল, আর ক্যাম্পাস জুড়ে স্লোগানই ছিল নির্বাচনী আমেজের প্রতিচ্ছবি।
১৯৮০ সালের কার্যনির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী আব্দুস সাদিক ভূঁইয়া সে সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তখন কোনো ডিজিটাল অস্তিত্বই ছিল না। এমনকি অফসেট ছাপাখানাও ছিল না। হ্যান্ড প্রেসে ধূসর কাগজে সাধারণ লিফলেট ছাপা হতো।’
চারুকলার শিক্ষার্থীরা দেয়াল লিখন, ব্যানার ও ফেস্টুনে রঙতুলি দিয়ে শৈল্পিকভাবে প্রচারণার বার্তা ফুটিয়ে তুলতেন। প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্বগুণ ও যোগাযোগ দক্ষতা ছিল প্রধান মূলধন, যদিও ১৯৯০-এর দিকে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাব ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করে।
ডিজিটাল বিপ্লব: ২০১৯-২০২৫
প্রায় তিন দশকের বিরতির পর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন প্রচারণার ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক, প্রথমবারের মতো নির্বাচনী প্রচারণার মূল প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। ফেসবুক লাইভ, ভিডিও বার্তা, গ্রাফিক পোস্টের পাশাপাশি তখনও সাদাকালো লিফলেট ও ব্যানার প্রচলিত ছিল।
সে সময় শামসুন্নাহার হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত এবং বর্তমানে কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপি প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘২০১৯ সালে ম্যানুয়াল প্রচারণা এখনও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ডিজিটাল প্রচারণার পাশাপাশি। তখনও প্রার্থীরা ব্যানার ও সাদাকালো লিফলেট ব্যবহার করতেন।’
২০২৫ সালে এসে ডাকসু প্রচারণা একেবারেই ডিজিটাল আধুনিকতায় রূপ নিয়েছে। প্রার্থীরা এখন প্রফেশনাল ক্যাম্পেইন ভিডিও, ইনফোগ্রাফিক, ডিজিটাল মেনিফেস্টো, ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব সাক্ষাৎকার ব্যবহার করে মুহূর্তেই হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। অনলাইন জরিপ, ইমেজ ম্যানেজমেন্ট ও ব্র্যান্ডিং নির্বাচনী মাঠের নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে।
বিধিনিষেধে এবার নতুন ধারা
তবে এই আধুনিক প্রচারণার মাঝেই এসেছে বড় ধরনের নিয়ন্ত্রক নীতি। গত ২৭ আগস্ট রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানীর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে প্রচারণার ধরনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আচরণবিধির ধারা ৭(ক) অনুযায়ী শুধুমাত্র সাদাকালো লিফলেট ও হ্যান্ডবিল ছাপা ও বিতরণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পিভিসি/কাপড়ের ব্যানার, ফেস্টুন, বোর্ড ও স্টিকার পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
অধ্যাপক রব্বানী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে কোনো ব্যানার, ফেস্টুন বা বোর্ড থাকবে না। কোথাও স্টিকারও লাগানো যাবে না। শুধু সাদাকালো লিফলেট বিতরণ করা যাবে। কেউ এই বিধিনিষেধ ভঙ্গ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শিক্ষার্থীদের মতে, এই নীতিগত পরিবর্তন নির্বাচনী খরচ নিয়ন্ত্রণ ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টার প্রতিফলন।
ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা কেবল ভোট প্রার্থনার প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি যেন প্রযুক্তির বিকাশ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনেরও আয়না। দেয়াল লিখন থেকে ডিজিটাল মেনিফেস্টো, রাতভর মিছিল থেকে ফেসবুক লাইভ— এই রূপান্তরই দেখিয়ে দেয় সময়ের স্রোতে ডাকসুর প্রচারণা কতটা পাল্টে গেছে।