
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতন হলে সারা দেশে গাঢাকা দেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। অনেক নেতাকর্মীই জনরোষের ভয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এদের বড় অংশ আশ্রয় নেন নেপালে। দেশটিতে আশ্রয় নেয়া কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং স্থানীয় হোটেলের কর্মচারীরা জানান, সেখানে তিন হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী থাকছেন।
আশ্রয় নেয়া নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সদরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী শফিকুর রহমান (শফিক হাজী), শায়েস্তাগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান মাসুদ, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি প্রসণজিৎ দেব, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব, সাবেক সভাপতি গোলাম কিবরিয়া, রাজশাহী কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি রাশিক দত্ত, কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম সাদ্দাম হোসাইন, বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক রইজ আহমেদ মান্না, ঢাকা মহানগর যুবলীগের সহসভাপতি নাজমুল হোসেন টুটুল। কাঠমান্ডুর থামেল এলাকায় অবস্থিত হোটেল কক্সবাজারের দোতলায় ২০৩ নম্বর রুমে ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেত্রীর থাকার তথ্য পাওয়া গেলেও তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ছাড়াও একাধিক সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী নেপালে অবস্থান করছেন। জানা যায়, নেপালের পর্যটন রাজধানী থামেল, অন্যতম ভ্রমণকেন্দ্র পোখারা এবং রাজধানী কাঠমান্ডুর আবাসিক হোটেলগুলোতে তারা সময় পার করছেন।
আওয়ামী লীগের এসব নেতাকর্মীর বেশির ভাগ সরাসরি বাংলাদেশ থেকে পর্যটক হিসেবে নেপালে ঢুকলেও অনেকে পার্শবর্তী ভারত ও অন্য দেশ থেকে নেপালে এসেছেন।
ছদ্ম পরিচয়ে শায়েস্তাগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান মাসুদের সাথে থামেলের বাঙালি রেস্তোরাঁ ইয়ামিন হোটেলে কথা হলে তিনি নয়া দিগন্ত প্রতিবেদককে জানান, ২ সেপ্টেম্বর তিনি পর্যটক হিসেবে নেপালে প্রবেশ করেন। এরপর ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে এক বছরের জন্য বিজনেস ভিসা গ্রহণ করে সেখানে অবস্থান করছেন। তিনি হোটেল বগুড়ার পাশের বিল্ডিংয়ে ২৮ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় একটি রুমে থাকেন।
তিনি জানান, নেপালের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় বেশির ভাগ মফস্বল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অবস্থান করছেন। তারা মামলার চেয়ে স্থানীয় জনরোষের ভয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। তিনি আরো জানান, নেপালে অবস্থান নেয়া অনেক আওয়ামী নেতাকর্মীর ভারতীয় ভিসা থাকায় তারা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রথম ভারতে যান। ভারতে ভিসার মেয়াদ শেষ হলে এবং সম্প্রতি ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশইনের মতো সমস্যা শুরু হলে তারা নেপালে চলে যান। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ইউরোপ বা আমেরিকার উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে পারি জমানোর চেষ্টা করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থামেলের হোটেল কক্সবাজারের এক বাংলাদেশী কর্মচারী নয়া দিগন্তকে বলেন, হাসিনার পতনের পরে তাদের হোটেলে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকে কিছুদিন নেপালে থেকে বিভিন্ন উন্নত দেশে চলে গেছেন। এখনো এই হোটেলে ছাত্রলীগের এক বড় নেত্রী অবস্থান করছেন বলে জানান তিনি।
ছদ্ম পরিচয়ে নারায়ণগঞ্জের মাজদাঈর এলাকার ফারুক নামে এক আওয়ামী নেতার সাথে বন্ধুত্ব হলে তিনি জানান, থামেলের আশপাশে থাকেন সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। রাত ১১টার পরে মাঝেমধ্যে থামেলের এলওডি ক্লাবে যান তিনি। পরে দু’দিন ক্লাবটিতে অপেক্ষা করে ২১ আগস্ট রাতে ক্লাবটিতে দেখা মিলে আওয়ামী লীগের সাবেক এই মন্ত্রীর। তিনি ১০-১২ জনের একটি দল নিয়ে ক্লাবটিতে প্রবেশ করেন। ক্লাবের দ্বিতীয় তলার একটা টেবিলে দীর্ঘ সময় থাকেন। এ সময় তার সাথে একাধিক বিদেশী নাগরিককে দেখা যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীকে তার সাথে দেখা করতে দেখা যায়। পরে ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ক্লাব থেকে বের হন তিনি। তবে ক্লাবটিতে ক্যামেরায় ছবি তোলা ও ভিডিও করা নিষিদ্ধ ছিল।
একটি সূত্র জানায়, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ৫ আগস্টের সময় দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি পরে অন্য একটি দেশ থেকে নেপালে আসেন এবং প্রায় আট মাস নেপালে অবস্থান করছেন। তবে তিনি কোনো দেশ থেকে নেপালে এসেছেন সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেনি সূত্রটি।
এ ছাড়াও নেপালে অবস্থান করা ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী শফিকুর রহমানের (শফিক হাজী) সাথে একটি সোর্সের মাধ্যমে দেখা করার চেষ্টা করলে তিনি জানান, তিনি কাঠমান্ডুর বাইরে আছেন। দু’দিন আগে ফোন করলে দেখা করা যেত।
এ দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন। ফেব্রুয়ারির ঘোষিত সময় নির্বাচন না হলে দেশে গিয়ে রাজপথে আন্দোলনের আভাস রয়েছে দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে।
এ দিকে নেপালে বসবাস করা শ্রমিক ও ব্যবসায়ী বাংলাদেশী প্রবাসীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতকর্মীরা নেপালে আসা বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন। ফলে দেশের বাইরে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে।