Image description

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) চাকরির নামে ৫৮ লাখ টাকা নিয়েছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা। সেই টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে ভাড়ায় খাটেন ছাত্রদল নেতা। ভাগ বসান ৩ লাখ টাকার চেকে। এই ৩ লাখ টাকা উদ্ধারে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে মধ্যস্ততায় নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাংবাদিক। সাবিনা ইয়াসমিন নামে এক ছাত্রী প্রক্টর বরাবর অভিযোগ দিলে তা তুলে নিতে সম্প্রতি চাপ দিয়েছেন ওই সাংবাদিক; যার ফোন রেকর্ড ইতোমধ্যেই ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে।

জানা গেছে, অভিযুক্ত ওই সাংবাদিকের নাম আল ইয়ামিম আফ্রিদি। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক দিনকালের চবি প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া তিনি বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। 

ফাঁস হওয়া ১৩ মিনিট ১২ সেকেন্ডের ওই ফোনকলে প্রক্টর অফিস বরাবর চেক আত্মসাৎ করার অভিযোগ তুলে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছাত্রদল নেতার কাছ থেকে চেক নিয়ে যেতে বলা হয়। 

ফোন রেকর্ডে সাবিনা ইয়াসমিনকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, ‘আমি আপনাকে রিকোয়েস্ট করতেছি যে, আপু আপনার লইগা ভালো হইবে সেটা করেন, আমরা যেটা বলতেছি ঐটা ভালো হবে (প্রক্টর অফিসে দেওয়া অভিযোগ তুলে নেওয়া)। আর যদি না করেন তাহলে সেটা ভুল হবে। এখন আপনি আমাকে বলেন কি করবেন? আপনি চেকটা নিতে পারেন তাহলে নিয়ে নেন। এখন এটা আমাকে বলেন। আবারো ভুল কইরেন না, চেক পাইবেন না, চেক না পাইলে টাকাও তুলতে পারবেন না। প্রশাসন আপনার যতই পক্ষে থাকুক চেক না থাকলে কিন্তু কিছুই করতে পারবে না। সহজে আসেন আপু।’

আফ্রিদিকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘হাবিব ভাই পলিটিক্যাল পারসন। এটা টাকা খাওয়ার ধান্ধায় বইসা থাকে। আপনার চেক দেওয়া দোষ হইয়া গেছে। এখন আবার ভুল কইরেন না আপু। আপনি হালকা একটা টাচ দেন। উনাদের এখানে রিস্ক আছে তবে এটা প্রিভেন্ট করতে পারবে। ওনাদের এখানে প্রিভেন্ট করার অনেক কিছু আছে। কিন্তু প্রিভেন্ট যদি কইরা ফালায় তাহলে আপনি আর চেক পাইবেন না।’

সাংবাদিকদের এ বিষয়ে কিছু না বলার জন্যেও অনুরোধ জানান আফ্রিদি। তিনি বলেন, ‘আপনি বলতেছেন (হাবিবের সাথে) সামনাসামনি কথা বলতে, উনার (হাবিব) চেহারা ওখানে দেখা গেলে তো এটা তো সবাইরে মাইরা দিবে, সাথে সাথে নিউজ কইরা দিবে। ওরা তো বসে আছে নিউজ করার জন্য। এটা নরমাল টাকার বিষয় হতো তাহলে দিয়ে দিতো। কিন্তু এটা তো টাকার বিষয় না। এটা হলো সিংহাসনের বিষয়। প্রেসিডেন্ট সিংহাসন সামনের বছর খেলাডা এই জায়গায়। আপনার মনে হয় এত বড় একটা বিষয়ে আপনারে গুটি হিসেবে চাইতাছে। আপনি যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন তাহলে চেকটা পাই যাবেন আর যদি না বলেন তাহলে এই পক্ষ বলবে যেহেতু আমি পাবোই না তাহলে আমি চেকটা দিবই না। আর এটা ওরা পরে প্রিভেন্ট করিয়ে নিবে। তাহলে আপনি আপু সরোয়ারের (সাংবাদিক) সাথে কথা বলিয়েন না। আপনি এখন ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলুন।’

জানতে চাইলে এ বিষয়ে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘টাকা উদ্ধারের জন্য ছাত্রদলের আহসান হাবীবের সাহায্য নিই। ক্যাম্পাসের সাংবাদিক আফ্রিদি তার কাছে আমাকে রেফার করে। আমার টাকা তুলে দেওয়ার জন্য হাবিব আমার থেকে ২টা চেক নেয়। একটি ১৫ লাখ টাকা, আরেকটি ৩ লাখ টাকা। কিন্তু সে টাকা তুলে দিচ্ছে না। তাই আমি তার কাছে চেকগুলো ফেরত চাই। সে আজ দিবে কাল দিবে করে কালক্ষেপণ করছে কিন্তু চেক দিচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাঝখানে সে জানায় যে, ছাত্রদলের চবি সভাপতি আলাউদ্দীন মহসীনও এ বিষয়টি দেখতেছে। তখন আমি বললাম, আমি তাকে চিনি না। আপনি চেক ফেরত দেন। তখন সে চেক দিতে গড়িমসি করে। পরে সে আমাকে ১৫ লাখ টাকার একটি চেক দেয় আর ৩ লাখ টাকার চেক রেখে দেয়। এ চেকের কথা বললে আহসান হাবীব রেসপন্স করে না। পরবর্তীতে আমি একটি মাধ্যমে যখন চেক নেওয়ার চেষ্টা করি, তখন সে বলে যে চেক দিবে না। আমার যার সাথে লেনদেন তাকে তুলে নিয়ে টাকা আদায় করবে। তবে আমাকে চেক দিবে না। আমি যা পারি যেন করি। সে কিছুতেই চেক দিবে না। গত জুলাইয়ের ২২ তারিখ এমরানের কাছে যেয়ে হাবিব বলে, চেক আমার কাছে আছে আমাকে টাকা দিতে হবে। তারপর আমি ২৪ তারিখে প্রক্টরের কাছে অভিযোগ দিই। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার পর আমাকে ফোন দিয়ে বলা হয় চেক নিতে হলে, আমাকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিতে হবে। তখন আমি বলি নিব না। তারপর তারা বলে, আমাকে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে এবং অভিযোগ তুলে নিতে হবে। এছাড়া বলতে হবে একটি রাজনৈতিক দল আমাকে চাপ সৃষ্টি করে এই অভিযোগ দিতে বাধ্য করেছে। এমরানের সাথে আমার টাকার লেনদেন হয়। এই টাকা উদ্ধারের জন্য আমি বিচার বা কারো মধ্যস্থতা চেয়েছিলাম। কিন্তু আফ্রিদি আমাকে পাঠালো হাবিবের কাছে। পরে বুঝলাম সে নিজের স্বার্থে আমার সাহায্য করতে এসেছে।’

এদিকে কল রেকর্ডের বিষয়টি অস্বীকার করেন অভিযুক্ত সাংবাদিক আল ইয়ামিম আফ্রিদি। তিনি বলেন, ‘ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডটি আমার না। কল রেকর্ড হলে অবশ্যই কল স্টোরি থাকতে হবে। জুলাই মাসের যে সময়ের কথা বলতেছে ঐ সময়ে তার সাথে সরাসরি তো দূরের কথা ফোনেও কথা বলিনি। এই ফোন রেকর্ডটি একটি অভিনয় ছিলো এবং যারা এই অভিনয়টি করেছে তাদের একজন এ বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে এটি অভিনয়।’

আফ্রিদি আরও বলেন, ‘গত বছরের ডিসেম্বরে তার সাথে কথা বলেছি। সে আমার কাছে এসেছিল তার কাছ থেকে নাকি এমরান নামের এক লোক টাকা নিয়েছে। তখন আমি এমরানের তথ্যগুলো দিতে বলেছি। যখন তথ্যগুলো সার্ভে করে দেখেছি এমরান বড় দোসর এবং তার সাথে সে দালালি করেছে তারা দুজনেই অপরাধী। তখন আমি কেন কোনো সাংবাদিকই তাকে সাহায্য করেনি। একটা মিথ্যা রেকর্ড বানিয়েছে যার না আছে কল রেকর্ডের স্টোরি না আছে ফরেনসিক রিপোর্ট।’

এদিকে কল রেকর্ডটি আফ্রিদির বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। রেকর্ডটি আফ্রিদি নিজের না বলে অস্বীকার করলেও এই রেকর্ডটি স্বয়ং আফ্রিদির সে বিষয়ে নিশ্চিত করেছে সূত্রগুলো। 

বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, রেকর্ডটি আফ্রিদির। তবে, এটি বানানো হয়েছে বলে বক্তব্য দেওয়ার জন্য একজনকে চাপ প্রয়োগও করেছেন তিনি৷ পাশাপাশি এ ব্যাপারে সাংবাদিককে যেনো বলা হয় এই রেকর্ডটি বানানো এই মর্মে চাপও প্রয়োগ করেন আফ্রিদি । বিষয়টি স্বীকারও করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি। 

এদিকে ছাত্রদলকর্মী আহসান হাবিব গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অভিযোগ দেওয়া মেয়ের পরিবার আওয়ামীলীগের সাথে যুক্ত। তারা একটি নিয়োগের সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। আমাকে এবং আমার সংগঠনের মানহানি করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অভিযোগ করেছে। আমি কোনোভাবেই এগুলোর সাথে জড়িত নই।’

এই বিষয়ে চবির প্রক্টর অধ্যাপক ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ বলেন, ‘নিয়োগের জন্য ঘুষ লেনদেন এবং প্রতারণার বিষয়ে সাবিনা ইয়াসমিন নামে এক শিক্ষার্থী একটি অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু অভিযুক্তদের একজন আহসান হাবিব আবার মানহানির অভিযোগ এনে সাবিনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দিয়েছেন।’ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দুটি বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে- চাকরির জন্য ঘুষ লেনদেন, প্রতারণা, চেক ফেরত না দেয়া কিংবা চেক প্রত্যাখ্যান হওয়া এগুলো আইনি বিষয়। আইনিভাবে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তখন তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে। অবশ্য, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন প্রমাণিত হওয়ায় ইতোমধ্যে একজন কর্মচারীকে আমরা বরখাস্ত করেছি।’

প্রসঙ্গত, গত ২৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী সাবিনা ইয়াসমিন প্রক্টর বরাবর ছাত্রদল নেতা আহসান হাবীবের বিরুদ্ধে তিন লাখ টাকার চেক আত্মসাতের লিখিত অভিযোগ দেন। এই অভিযোগের পর সাংবাদিক আফ্রিদি ওই ছাত্রীকে অভিযোগ তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করেন। 

এর আগে, গত ৬ জানুয়ারি হাবিবের মধ্যস্থতায় সাবিনাকে ১০ লাখ টাকা প্রদান করবেন বলে জানান এমরান। সেদিন সন্ধ্যায় সাবিনা ইয়াসমিন হাটহাজারীর একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখেন এমরানের হয়ে সমঝোতার জন্য এসেছেন চবি ছাত্রদল সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিনসহ বেশ কয়েকজন জন ছাত্রদলকর্মী। তারা টাকা কম নিতে চাপাচাপি করলে সাবিনা সেখান থেকে চলে আসেন। এর কিছুদিন পর টাকা উদ্ধার করবে বলে জানালে ১৫ লাখ ও ৩ লাখ টাকার দুটি চেক হাবিবকে দেন ইয়াসমিন। এই চেক দুটি সাবিনাকে দিয়েছিলেন কর্মচারী এমরান। তবে চেক বাউন্সের অভিযোগ করেন সাবিনা। তাই চেকের বিপরীতে ক্যাশ আদায়ের জন্য ছাত্রদলের সাহায্য নেন তিনি। তবে টাকা উদ্ধার না করে উল্টো যোগাযোগ বন্ধ করে দেন ছাত্রদলের এই কর্মী।