
জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শিগগির শেষ দফার আলোচনায় বসতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ লক্ষ্যে ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়িয়ে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এমন অবস্থায় বিএনপিও কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। কারণ, দলটি জুলাই সনদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সনদ কার্যকরের পক্ষে। গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সহসভাপতি করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে। প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কমিশন সময় পায় ছয় মাস। সে সময় শেষ হওয়ার তারিখ আগামী ১৫ আগস্ট।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই পর্বের আলোচনায় ৮২টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সংলাপে ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ১১টিতে দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে। বাকি ৯টিতে কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তবে এর সাতটিতে বিএনপির, একটিতে জামায়াতে ইসলামীর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) রয়েছে। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ।
তবে এই সনদ তথা সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গত শুক্রবার ঐকমত্য কমিশন বলেছিল, বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ভর করবে বিশেষজ্ঞ মতামত ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় গত রোববার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে কমিশন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শেষ হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন।
সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। জুলাই জাতীয় সনদের খসড়ায় বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দুই বছরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি একমত। তবে জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) আরও কিছু দল বলছে ভিন্ন কথা। তারা মনে করে, শুধু অঙ্গীকার থাকলে হবে না; জুলাই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে হবে।
জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিশনের সময় বাড়ানোয় স্থায়ী কমিটির কোনো আপত্তি নেই। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির আলোচনায় বিএনপিকে ডাকা হলে তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। সংস্কার বাস্তবায়ন বিষয়ে কোনো নেতিবাচক দায়ভার বিএনপি নিতে চায় না। দলটির দাবি, এটা তাদের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর অপপ্রচার। সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি অত্যন্ত আন্তরিক। সে কারণে শুরু থেকেই ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে তারা। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, ঐকমত্য হওয়া এমন সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো সরকার আইনি প্রক্রিয়ায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে যে কোনো সময় করতে পারে। শুধু সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো নির্বাচিত সংসদ করবে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। সংশোধিত আরপিওর খসড়া নিয়ে বড় ধরনের কোনো আপত্তি নেই বিএনপির। দলটি বলছে, খসড়ায় যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই তাদের দাবি ছিল।
আরপিও সংশোধন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কালবেলাকে বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তি—সেটা আমাদের প্রস্তাব ছিল, সেটা ভালো হয়েছে। কোথাও কারচুপি হলে পুরো আসনের ভোট বাতিলের যে ক্ষমতাটা আগে ছিল, সেটা পুনর্বহাল হয়েছে। সেটাও ভালো, তবে এর অপব্যবহার যাতে না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ‘না’ ভোটের বিধান—সেটা প্রথমবারের মতো করা হচ্ছে, এটা ভালো। তবে একবার একটা নির্বাচন হলে সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যাবে, এটা কতটুকু উপযুক্ত হলো। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এবং সারা জাতির দাবি ছিল যে, ইভিএম বাতিল করতে হবে। ইভিএম থাকছে না, এটা ভালো। এ ছাড়া আমাদের দাবি ছিল, ভোটে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞার মধ্যে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হবে। এটা অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এটা ইতিবাচক।
সূত্রমতে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস কার্যক্রম নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ইসির নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের জন্য বিএনপি গঠিত কমিটির প্রধান নজরুল ইসলাম খান বৈঠকে এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদন তৈরি করেন তিনি।