Image description
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

রাজনীতিতে নানান আলোচনার জন্ম দিয়ে অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রাখা হয়েছে। ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দলের নেতারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছেন, কেউ আবার ব্যক্ত করেছেন হতাশা। সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবিধানের তপশিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত করার কথা থাকায় এর প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ ছাড়া ঘোষণাপত্রে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলেও তা সাম্প্রতিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলের সমালোচনা করা হলেও এর আগের কর্তৃত্ববাদকে তুলে ধরা হয়নি বলেও মত দিয়েছেন তারা।

জুলাই ঘোষণাপত্র ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ৫ আগস্ট জাতীয় নির্বাচনের একটি সময়সীমা ঘোষণা করেছে। জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের প্রয়াসেই পাঠ করা হয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্র।

জামায়াতে ইসলামী মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হয়নি। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ জুলাই জাতীয় ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যে প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল, তা পূরণ না হওয়ায় জনগণের মধ্যে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যে নতুনভাবে উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের রূপরেখা কী হবে, তা জাতির কাছে অস্পষ্ট।

 

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, এই ভূখণ্ডের মানুষের উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের অন্যতম রেফারেন্স পয়েন্ট ১৯৪৭-কে এখানে উল্লেখ করা হয়নি। পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা গণহত্যা, বিচারিক হত্যাকাণ্ড, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার পর আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলন, মোদিবিরোধী আন্দোলনের কথা এ ঘোষণাপত্রে উল্লেখ নেই।

 
 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এই ঘোষণাপত্রের বিষয়বস্তু আমাদের আগে জানানো হয়নি। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল ঘোষণার আগে আমাদের মতামত না নিয়ে উপস্থিত রেখে সমর্থন নেওয়া হয়েছে, যা ছিল আমাদের জন্য বিব্রতকর। তারপরও প্রত্যাশিত দিনে ঘোষণাপত্র পঠিত হয়েছে, এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, ঘোষণাপত্রে ফ্যাসিবাদের দোসর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির কথাও উপেক্ষা করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিতে পারে।

 

জুলাই ঘোষণাপত্রে গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট অন্তর্ভুক্ত না করলে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ। দলটির সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট কোটা সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস বাদ দিয়ে মিথ্যা ইতিহাসের ওপর জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, গণঅধিকার পরিষদ ও ছাত্র অধিকার পরিষদের ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস বাদ দিতে পরিকল্পিতভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে।

গণঅধিকারের এ নেতা বলেন, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করায় ১/১১ সৃষ্টির ধোঁয়াশা কেটে গেছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ কালবেলাকে বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ও বিচারের বিষয়টি দেশের নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও ঘোষণাপত্র থেকে বাদ পড়েছে। এটা অসম্পূর্ণ। চব্বিশের গণহত্যাকারীদের বিচার জাতির খুবই কাঙ্ক্ষিত চাহিদা। এটি সম্পর্কেও সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। এ ছাড়া ইতিহাসের ধারাক্রমের সাতচল্লিশের দেশভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ আমরা সে সময় প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। আমরা নিজস্ব একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছিলাম, যা আজকে আমাদের বাংলাদেশ।

তিনি বলেন, ইতিহাসের পর্যালোচনা করতে গিয়ে বায়ান্ন ও একাত্তরের উল্লেখ আছে; কিন্তু একাত্তর তো আর এমনি হয়নি—সেটা অতীত ইতিহাসের ধারাক্রমেই আসছে। জুলাই ঘোষণাপত্রের ভাষা আরও উদ্দীপনা ও উজ্জীবনমূলক হওয়া উচিত ছিল। এতে ভাষার ধার, মাধুর্য ও আবেগ থাকা উচিত ছিল। ঘোষণাপত্রের ভাষা সাদামাটা বর্ণনা হয়ে গেছে।

সংবিধানের তপশিলে জুলাই ঘোষণাপত্রের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলায় তার প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা থাকল না বলে জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ‘তপশিল হলো সংবিধানের অংশ, কিন্তু তার কোনো প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা নেই। তপশিলের ধরনের ওপর নির্ভর করে, এটা কী হবে। যদি ঘোষণাপত্র তপশিলে আসে, তাহলে এর কোনো প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা নেই, থাকবে না। আর এটা, এখন যদি আপত্তি করে, বলে—না এই শব্দ আমার পছন্দ নয়। মানে সংসদের বিতর্কের সময়, এটি আমার পছন্দ নয়, ওইটা আমার পছন্দ নয়। তখন কী হবে? তখন এটাকে কাটাছেঁড়া করতে হবে। সবাই তো এটাকে একবারে ১০০ শতাংশ মানতে নাও পারে। তো যখন সংসদে আসবে, কোন দলে কত সদস্য থাকে, কার কী মত থাকে, সবাই তো এটার সঙ্গে একমত নাও হতে পারে। ঠিক প্রতিটি শব্দ যেভাবে লেখা হয়েছে, তার সঙ্গে একমত নাও থাকতে পারে।’

একটি সংগঠন বা রাজনৈতিক দল না দিয়ে ঘোষণাপত্রটি সরকার দেওয়ায় এটি আরও জোরদার হল কি না—এমন প্রশ্নে শাহদীন মালিক বলেন, এখন তো কোনো আইনগত ভিত্তি নাই। মানে এটাকে তো কোনো আইনি দলিল বলা যাবে না। কারণ, আইন তো করবেন সংসদ সদস্যরা। এর মানে আমার আইনগত দৃষ্টি থেকে এটার কোনো প্রায়োগিক মূল্য এ মুহূর্তে নেই। যদি এটা সংবিধানের তপশিলে আসে তাহলে হয়তো ওটা, কোনো কোনো সময় ওটার আমরা আশ্রয় নিতে পারব। তপশিলে কীভাবে আসে সেটার ওপর নির্ভর করবে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকা উচিত। যেহেতু আমরা ১৯৭১ সালে আমাদের যে আন্দোলন, যে যুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, এটাকে আমরা আমাদের স্বাধীনতা এবং জুলাই ২০২৪-কে আমরা বলছি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা-বাংলাদেশ ভার্সন টু’ তার এটা একটা স্বীকৃতি থাকা দরকার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যেকেরই এই যে ঘোষণাপত্র, এটার চেতনা, এটার তাৎপর্যটা ধারণ করা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ঘোষণাপত্রের আলোকে দেশ গঠনে একসঙ্গে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।